Main menu

হিস্ট্রি রিডিং (১): হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভের পরিচয়

।। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ।। শ্রী অতুল সুর ।। নালন্দা, ২০১৯ ।।

ধরেন ছায়ানট “বাংলা-ভাষায় সহজ নামাজ শিক্ষা” নামে একটা বই ছাপাইলো, বইটা হাতে নেয়ার আগেই আপনার একটু খটকা লাগবে না যে, ছায়ানট এই কাজ কেন করলো? কেন তারা নামাজ-পড়া শিখাইতে চাইতেছে?

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হইলো, পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ১৯৪২ সালে কলকাতায় হিন্দু মহসভার ছাপানো এই বই নিয়া এই প্রশ্ন কোনদিনই করা হয় নাই। (মানে, আমি দেখি নাই; উল্টা) এখনো এই বইটারে ইতিহাসের/এনথ্রোপলজির বই হিসাবে সেলিব্রেট করার রেওয়াজই চালু আছে বাংলাদেশে।

এইরকমের কনটেক্সট ছাড়া একটা বই’রে রিড করার মতো “ভুল” বাংলাদেশি ‘প্রগতিশীলদের’ পক্ষেই সম্ভব। কারণ এইখানে ‘শিক্ষিত, প্রগতিশীল’ হওয়া মানে হইতেছে আসলে কিছুটা হইলেও ‘হিন্দুত্ববাদী’ হইতে পারা। খুবই ডিপ-রুটেড একটা জিনিস এইটা। আর এই বইটা নানান দিক দিয়াই এই জিনিসটার একটা ভালো উদাহারণ।

বই’রে সম্মান করার রীতি এখনো বাংলাদেশে আছে। যে, আরে, বইয়ে লেখা হইছে! কথা সত্যি না হইলে লেখছে নাকি! এমনকি, ফেসবুকে এই ভাষায় লেখেন ঠিকাছে, বই কি এই ভাষায় লেখা যায় নাকি? 🙂 বই পায়ে লাগলে, সেইটা যে কোন বই-ই হোক, তুইলা নিয়া সালাম করার ব্যাপার কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিল। মানে, আমি বলতে চাইতেছি, বই একটা সেলিব্রেটেড জিনিস-ই খালি না, সেক্রেড জিনিসও।

বইয়ে মিথ্যা কথা বলা যায়, এইটা আমাদের জানা থাকলেও রিডার হিসাবে খেয়াল না করার জায়গা হইতেছে বইয়ের কনটেক্সট’টারে খেয়াল না করা।

যে কোন বই কোন একটা নির্দিষ্ট টাইমে একটা স্পেসিফিক অডিয়েন্সের জন্যই লেখা হইতেছে, ছাপা হইতেছে; এবং অই টাইম ও অডিয়েন্সের বাইরে গিয়া একটা ‘দৈব বাণী’ হিসাবে তারে রিড করা তো সম্ভব না। কিন্তু এইরকমের একটা ঘটনা আছে আমাদের দেশে, বই পড়ার ব্যাপারে। কনটেক্সট’টারে বাতিল কইরা দেয়া না, তারে বেইজ হিসাবে মাথায় না রাইখা পড়াটা। মোটামুটি কমন প্রাকটিস এইটা। যার ফলে, বেশিরভাগ বইয়ের রিভিউ/ক্রিটিকই দেখবেন ‘নিরপেক্ষ’ হওয়ার নামে খুবই বায়বীয় ঘটনা হয়া উঠে। মিনিংলেস ব্যাপার হয়া থাকে। আর বই-লেখা জিনিসটাও টাইমলেস ক্ল্যাসিক হইতে গিয়া রেসিয়াল ন্যারেটিভ হয়া উঠে।

তো, কনটেক্সট একটা ঘটনা। সেকেন্ড হইতেছে, একটা রেফারেন্স পয়েন্টগুলা। যেই আর্গুমেন্টই মেইক করা হইতেছে, সেইটার রেফারেন্স পয়েন্ট কোনগুলা – সেইটা খেয়াল করা। এই বইয়ে যে থিওরি’র বেসিসে ডিসিশান মেইক করা হইছে, তার অনেকগুলাই থিওরি হিসাবে ভ্যালিড নাই আর। যারা এনথ্রোপলজি নিয়া পড়াশোনা করছেন, তারা আরো বেটার বলতে পারবেন, আমি জাস্ট Cephalic Index নিয়া ব্রাউজ কইরা দেখলাম, ডেড একটা জিনিস এখন।

তারও আগে, অতুল সুর জাতির উদাহারণ দিতে গিয়া সবচে আগে মেনশন করছেন ‘আর্য জাতি’র নাম, যেই নামে কোন জাতি দুনিয়াতে কখনোই ছিল না, বরং একটা রেসিয়াল কনসেপ্ট হিসাবে এস্টাবলিশ এখন। জাতি অ্যাজ অ্যা নেশন এবং জাতি অ্যাজ অ্যা প্রফেশন – এইরকম বেসিক জায়গাগুলারই কোন ডিফরেন্সই করেন নাই। আবার বাঙালি জাতির উৎপত্তির স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে সোর্স মানছেন “হরিবংশ” “মৎস পুরাণ” ও “বায়ু পুরাণ”রে! শ’খানেক বছরের পুরান যেই স্ট্যাটিসটিকগুলা মেনশন করছেন, অইগুলারেও কোন প্রশ্ন ছাড়াই মাইনা নিছেন। মানে, পুরা জিনিসটা হয়া উঠছে উনিশ শতকের কলোনিয়াল বয়ান এবং তার প্রেক্ষিতে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার একটা ম্যাটেরিয়াল।

তো, এইটা কি উনি ভুল কইরা করছেন? না, এইখানে আসে থার্ড পয়েন্ট’টা। যে কোন চিন্তার বই-ই বেসিক কিছু আইডিয়া/ধারণা/অনুমানের জায়গা তো শুরু হয়, যেইগুলা আসলে রেফারেন্সগুলারে রিলিভেন্ট কইরা তোলে। আপনার ধারণা যদি থাকে, বাঙালি মানে হইতেছে হিন্দু; তাইলে সেইখানে হিন্দু-পুরাণগুলারেই রিলিভেন্ট মনে হইতে থাকবে। এইটা কোন দুর্ঘটনা না। এইরকম হিন্দুত্ববাদী হিস্ট্রি’র বইগুলাতে দেখবেন বেশিরভাগ কেইসেই, বৌদ্ধধর্মের কোন নাম-নিশানাও নাই! অ্যাজ ইফ এইরকম কিছু ছিলই না। আবার, জাতি নিয়া এতো আলাপ করতে গিয়া উনি “ভুলে” গেছিলেন যে, ‘বাঙালি মুসলমান’-ও একটা জাতি, যেইটা (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১০০ বছর আগে মেনশন করলেও) ১৯৭৬ সালের আগে সেইটা মনে করতে পারেন নাই অতুল সুর!

মানে, উনি যেই একটা ‘জ্ঞান-তাত্ত্বিক’ নিমার্ণ করতে চাইছেন বাঙালি জাতির অরিজিন-এর, সেইটা তো নন-পলিটিক্যাল ঘটনা না। বরং আমার ধারণা, বাংলাদেশের সব মুসলমানই হইতেছে ‘নিন্মবর্ণের হিন্দু’ – এই যে একটা মিথ ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত’র মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়ায়া আছে, সেইটা সম্ভব হইছে এই বইয়ের ভিতর দিয়া। কারণ, এই হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভে, ইন্ডিয়াতে মানুশ আসার পর থিকাই হিন্দু-ধর্ম আছে, এইটা কোন একটা হিস্ট্রিক্যাল মোমেন্টে যেন তৈরি হয় নাই! আমরা ইহুদি ধর্মের, ক্রিশ্চিয়ানিটির এবং ইসলামেরও একটা টাইমলাইন জানি যে, একটা সময়ে এই ধর্মগুলার শুরু হইছে। কিন্তু অন্য প্যাগান ধর্মগুলার মতো হিন্দু-ধর্মেরও একটা টাইমলাইন তো আছে, কিন্তু দেখবেন অই আলাপগুলারে হাইড করা হয়। [অন্য যে কোন প্যাগান ধর্মের মতোই হিন্দুত্ববাদিতা এই কারণে ফ্যাসিজমের লগে, রেসিয়াল অপ্রেশনের লগে খুব সহজেই মিলতে পারে।…] আর এই জায়গা থিকা, হিন্দুধর্মের অন্যসব জাতি/বর্ণের মতো মুসলমানরে একটা জাতি/বর্ণ হিসাবেই ক্যাটাগোরাইজ করা হয়, এবং এই বইয়েও সেইটাই করা হইছে।

তো, এই বইটা এইরকম সাম্প্রদায়িক-চিন্তার জন্য সেলিব্রেটেড হইছে বইলা আমার মনেহয় না। বইটাতে বরং একটা পপুলার-সায়েন্সের (বা আরো ঠিক কইরা বললে সিউডো-সায়েন্সের) একটা ফর্ম আছে; যেইগুলারে ধর্ম-চিন্তার এগেনেস্টে এক ধরণের সায়েন্টিফিক চিন্তার ঘটনা বইলা মনে হইতে থাকে আমাদের। মানে, এইটা যতোটা না কনটেন্ট, তার চাইতে অনেকবেশি ফর্মের ঘটনা। এই ফর্মের কারণেই কোন লজিক্যাল আলাপেও যদি ধর্মের নাম থাকে সেইগুলারে ‘সাম্প্রদায়িক’ আলাপ মনে হইতে থাকে আমাদের। এইটাও এই সিউডো-সায়েন্সের নামে ‘বিজ্ঞান-চিন্তার’ই ঘটনাই।

এই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক-চিন্তার বইটা বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ছাপা হইতেছে মানে এর রিডার তো আছে তাইলে। তো, এই বই পড়া বন্ধ কইরা দিতে হবে, বা ব্যান করতে হবে – এইরকম ভাবা হইলে সেইটা হবে আরেকটা বাজে চিন্তা; বরং এইটা যে একটা কোন হিস্ট্রির বই না এবং একটা পলিটিকাল ন্যারেটিভরে সেলিব্রেট করার ঘটনা – এই আইডেন্টিফিকেশন আরো স্ট্রং থিওরেটিক্যাল বেইজ থিকা স্পষ্ট করাটা দরকার। আমি জাস্ট এর একটা স্কেচ-ই রাখলাম এইখানে।

আমার কথা এইখানে তিনটা: যে কোন চিন্তার বইরে অবশ্যই কোন ‘নিরপেক্ষ’ জায়গা থিকা না পইড়া এর পলিটিক্যাল ও ইন্টেলেকচুয়াল কনটেক্সটে পড়া লাগবে আমাদেরকে; দুই, এর রেফারেন্সিয়াল বেইজটারে দেখতে হবে, কতোটা আপডেটেড; এবং এর উদ্দেশ্য ও ইমপ্লিকেশনগুলারে খেয়াল করতে হবে, আসলে কি জিনিস বলতে চাইতেছে এইটা, তার আর্গুমেন্টগুলার ভিতর দিয়া। আরেকটা সাবধানতার কথাও বইলা রাখতে চাই, এর এগেনেস্টে কোন “ইসলামি ইতিহাস” এই জায়গা থিকা বাইর হইতে আমাদেরকে হেল্প করবে না, বরং এর সাপ্লিমেন্টারি ঘটনাই হবে সেইটা।

/অক্টোবর ২৪, ২০২১

The following two tabs change content below.
Avatar photo
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →