Main menu

পলিটিক্স যা করে সাহিত্য তার চাইতেও দীর্ঘস্থায়ী বিষয়ের মামলা – মারিও বার্গাস ইয়োসা

This entry is part 20 of 27 in the series ইন্টারভিউ সিরিজ

ইয়োসা ও ইয়োসার সাহিত্য

জায়ান্ট শব্দের বাংলা এক সময় লেখা হইতো দিকপাল। লাতিন আমেরিকাতে না কেবল, মারিও বার্গাস ইয়োসা বিশ্বসাহিত্যেরই একজন দিকপাল। ২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেল না পাইলেও, তার এই অবস্থানের খুব একটা নড়চড় হইতো বলে মনে হয় না। মার্কেস, কোর্তাসার, আয়েন্দেসহ লাতিন আমেরিকান ‘ম্যাজিক রিয়ালিস্টদের’-এর মধ্যে ইয়োসা একটা খটকার মতো ‘রিয়ালিস্ট’ সাহিত্য প্রতিভা যার ক্ষেত্রে রিয়ালিস্ট কথাটা আবার উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখা লাগে। ইয়োসা আপাতভাবে ‘রিয়ালিস্ট’ অথচ ন্যারেশন টেকনিকে পোস্টমডার্নিস্ট।

কথাটা একটু খোলাসা করি।

উনিশ শতকীয় উপন্যাসের একটা আইডিয়াল ইয়োসার সাহিত্যে দেখা যায়। উনিশ শতকের উপন্যাসিকদের মধ্যে সমাজ বা বাস্তবতার ‘পুরা গল্প’ বলার যে চেষ্টা সেই ‘টোটালিটি’ তুইলা ধরার বিষয়টা ইয়োসার থাকায়, এমনকি তার ছোট উপন্যাসগুলিতেও এক ধরণের মহাকাব্যিক বিশালতা দেখা যায়। নানান পার্স্পেকটিভ থেকে, বয়ানভঙ্গির নানান টেকনিক, স্টাইল ও চরিত্রের সমবায়ের কারণে ইয়োসার লেখায় এক ধরণের ‘জটিল’ টোটালিটি দাঁড়ায়। এই ইন্টারভিউটা পড়তে গিয়াও দেখবেন, বেশিরভাগ প্রশ্নে ইয়োসার উত্তর একটু লম্বা, এইটা উনি বাচাল বা ত্যানা প্যাচাইতে পছন্দ করেন বইলা না। লম্বা করেন কারণ ইয়োসা একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়া একাধিক পার্স্পেক্টিভ হাজির করেন, নিজের মতটা দেয়ার পাশাপাশি অন্যের মতটাও উল্লেখ করেন। যেকোন বিষয়ে এইরকম মাল্টি-লেয়ার ও পার্স্পেক্টিভ তার সাহিত্যেরও প্রধান বৈশিষ্ট্য। টেকনিকে ও বয়ানে পোস্টমডার্নিস্ট অথচ ‘টোটাল’ রিয়ালিটি তুলে ধরার উনিশ শতকীয় আইডিয়ালের কারণে তার রচনারে অনেকে’সোশাল রিয়ালিস্ট’ নামের খুপড়িতে ফালায়। ইয়োসার লেখার পড়লে ব্যাপকতার অনুভুতি হয়—অন্তত আমার হয়—যেন শক্তিশালী কিছু একটা—আবেগ, বোধ, শাসরুদ্ধকর অদৃশ্য কিছু—আপনারে চারপাশ থেকে শক্ত করে ঘিরে রাখছে, আপনারে গ্রেফতার করে রাখছে। আপনি তার গ্রিপ থেকে বাইর হইতে পারতেছেন না। ইয়োসার অধিকাংশ রচনা আমি পড়ি নাই, কিন্তু ফিস্ট অফ দ্য গোট বা ওয়ার অফ দি এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড- এ এইটা আছে, এমনকি হালকা-এবসার্ড ও কমিক প্রেমিজের আন্ট জুলিয়া এন্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার পইড়াও আমার এমনটা মনে হইছে।

অসম্ভব উচ্চাভিলাষী সাহিত্যিকদের একটা প্রজন্ম গেছে যারা রাজনীতিরে সচেতনভাবে সাহিত্যে ব্যবহার করছেন। ইনফ্যাক্ট সাহিত্য আর রাজনীতিরে তারা অভিন্ন মনে করতেন। তারা সাহিত্য দিয়া পলিটিক্স করতে যান নাই, —প্রোপাগান্ডা হয়ে যাওয়ার আশঙ্ক থাকেই—, কিন্তু রাজনৈতিক বিষয় উপন্যাসে এমন নুয়্যান্সসহ আনছেন যে তা এপিক হয়ে উঠছে, মোটেই প্রোপাগান্ডা হয় নাই। যেমন–গুন্টার গ্রাস। মার্কেস। ফুয়েন্তেস (তবে বোর্হেস বা কোর্তাসাররা না)। গুন্টার গ্রাসদের প্রজন্ম মনে হয় দুনিয়া থেকেই উঠে গেছে। ইয়োসা বা মিশেল হলেবেকের মতো দুই-একজন জীবিত থাকলেও এই ধরণের লেখকেরা এখন মোটামুটি বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি। ‘রাজনৈতিক বিবেক’ পরিচয়টা এখন অনেক লেখক এড়াইতে চান। ইয়োসা এই দিক দিয়া বিরল। তিনি সচেতনভাবে পলিটিকাল। ফলে ইয়োসার লেখা প্রায়ই রক্তাক্ত, শকিং, ভায়োলেন্ট, শ্বাসরুদ্ধকর। অথচ প্রায়ই চিপা-চাপা দিয়া ইরোটিক ও কমিক, কিন্তু মূলত বিহ্বলতা-মাখানো সুন্দর। এই সবগুলা উপাদান মিলে তার সাহিত্য অস্বস্তিকর এক ধরণের বিউটি তৈরি করে।

কী আছে এই বইয়ে?

প্যারিস রিভিউর ইন্টারভিউগুলার কমন ফিচার হইতেছে: লেখকের নিত্যদিনের ও ব্যক্তিগত জীবনে ছোট্ট একটু উঁকি মারা, কিছু সাজেশন, লাইফস্টাইল, লেখার কলকব্জা বিষয়ে কিছু কমেন্ট। এইখানেও তার ব্যত্যয় ঘটে নাই। ইয়োসা কেমনে চিন্তা করেন, তার সাহিত্য দর্শন কেমন, লেখার ক্ষেত্রে তার ডেইলি রুটিন কী? ইয়োসা সেইসব লেখকদের একজন যারা বায়বীয় নানান মিউজ ও ক্রিয়েটিভিটির মিথ উৎপাদন করেন না। আইডিয়া থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে একটা লেখার গড়ে ওঠা ও শেষ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটা তার জন্যে কেমন সেই বিষয়ের বিস্তারিত আলাপ আছে এই ইন্টারভিউয়ে। লেখা ইয়োসার কাছে নিছক লেখালেখি না, লেখা কঠিন একটা ডিসিপ্লিনের ব্যাপার যা লেখকের কাছ থেকে টোটাল কমিটমেন্ট দাবি করে।

লাতিন আমেরিকার বোর্হেস, মার্কেস, সারমিয়েন্তো, কার্পেন্তিয়ের, ওক্তাবিও পাজ, নেরুদাসহ, ইউরোপ ও আমেরিকার রথী-মহারথী সাহিত্যিকদের নিয়া ইয়োসার মতামত আছে ইন্টারভিউয়ে। আছে এদের কয়েকজনের সাথে ইয়োসার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নানান গল্প; বিশেষ করে মার্কেস ও বোর্হেস বিষয়ে মজার এনেকডোটস।

লেখার কলকব্জা নিয়াও আছে দারুণ কিছু পর্যবেক্ষণ। ইয়োসা ফ্লবেরের কাছ থিকা শিখছেন ট্যালেন্ট হইতেছে কঠিন ডিসিপ্লিন আর ধৈর্য্য। ফলে চাকরি করার মতো প্রতিদিন ইয়োসা তার লেখার টেবিলে বসেন। ফকনারের কাছ থিকা শিখছেন সাহিত্যের বড় একটা অংশ ফর্মের খেলা– স্ট্রাকচারের মামলা— ফলে যেকোনো থিমের লেখারে মহৎ বা দূর্বল কইরা তুলতে পারে ফর্ম। লেখার কলকব্জায় বেশি আগ্রহীরা ইয়োসার লেটার্স টু এ ইয়াং নভেলিস্ট নামে চমৎকার চটি-সাইজ বইটা দেখতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার ভাল লাগার একটা দিক হইতেছে, সিরিয়াস লেখকদের জন্যে ইন্টারভিউটা খুব ইন্সপায়ারিং।

ইয়োসার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে সাহিত্য ছাড়া সমাজ—যেই সমাজে সাহিত্য জিনিসটা সাইডলাইনে থাকে, সাহিত্য অল্প কিছু লোকের অবসর বিনোদনে রূপ দেয়— আধ্যাত্মিকভাবে বর্বর হইতে বাধ্য। সেই সমাজে মানুষের স্বাধীনতা বা মুক্তি থাকে না। ইয়োসার কাছে সাহিত্য জীবনের জরুরি ও সিরিয়াস একটা বিষয়। সাহিত্যের প্রতি তার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাও ব্যাপক। আপনি তার কথা শুনলেই (= পড়লেই) বুঝতে সাহিত্য নিয়া কথা কইতে সে কতটা উৎসাহী। এই ইন্টারভিউটা পইড়া আমার মনে হইছে সাহিত্য নিয়া ইয়োসার উৎসাহ ও সিরিয়াসনেস সংক্রামক। ইয়োসার এই সাহিত্য-প্রীতি বাংলার পাঠকদের মধ্যেও সংক্রমিত হৌক।

কে. এম. রাকিব
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
ধানমন্ডি, ঢাকা।

[ইন্টারভিউ’র অংশ]

ইন্টারভিউয়ার: আপনি বলছেন মায়তা আর দ্য ওয়্যার অফ দি এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড -এ আপনি সত্যিজ্ঞানের ধারণা নিয়াই মিথ্যা বলছেন। এইটা খোলাসা করবেন?

ইয়োসা: বানোয়াট কাহিনীর জন্য আমারে সবসময় একদম বাস্তব অবস্থা থেকে শুরু করতে হয়। সব উপন্যাসিকের জন্যে এইটা সত্যি কিনা জানি না, কল্পনার জন্যে আমার সবসময়ই বাস্তবের স্প্রিংবোর্ড লাগে। এই কারণে আমি গবেষণা করি আর ঘটনাস্থল আমি ভিজিট করি, বাস্তবরে পুনরায় নির্মাণের জন্যে না। আমি জানি এইটা অসম্ভব। চেষ্টা করলেও তার ফল ভালো মানের হবে না, সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু হবে।

ইন্টারভিউয়ার: মায়তার শেষদিকে, ন্যারেটর আমাদের জানায় যে,যিনি এখন একটা বারের মালিক সেই প্রধান চরিত্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলা মনে করতে কষ্ট হইতেছে। এইটা কি আসলেই ঘটছে? এইরকম কোনো মানুষ কি আসলেই আছে?

ইয়োসা: হ্যা, আছে, যদিও বইয়ে যেমনটা দেখায় তেমন সে না। অনেক কিছু বদলাইছি, অনেক কিছু এড করছি। কিন্তু মোটাদাগে এক সময়ের মিলিট্যান্ট ট্রটস্কিপন্থি ও কয়েক বার জেল খাটা এক লোক আছে এমন এক লোকের সাথে এই চরিত্রের মিল আছে। তার সাথে কথা বইলা অবাক হয়ে যাই যখন জানতে পারি যে যেইটারে আমি তার জীবনের ক্রুশিয়াল টাইম ভাবছি সেইটা তার কাছে সেকেন্ডারি —অন্যদের কাছে যা এডভেঞ্চার তার কাছে ছকে বাঁধা হইতে পারে। শেষ অধ্যায়ের জন্য আমি আইডিয়াটা পাইছি এই ঘটনা থেকে। আলাপ চলাকালে যখন আমি বুঝতে পারলাম যে তার চাইতে সম্পর্কের বিষয়ে আমি ভালো জানি– আমি ধাক্কার মতো খাইছি। সে অনেককিছুই ভুইলা গেছে আর অনেক বিষয়ে আছে যা সে জানতোই না। আমি মনে করি শেষ অধ্যায়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এইটা বইয়ের পুরা মিনিংটাই বদলায়ে দেয়।

ইন্টারভিউয়ার: আন্ট জুলিয়া আর দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার– এর সেই পেদ্রো কামাচোর সম্পর্কে বলেন যে রেডিওর জন্যে সিরিয়াল লেখে আর প্লট তালগোল পাকায়ে ফালায়।

ইয়োসা: পেদ্রো কামাচো বলে কেউ কোনোদিন ছিল না। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আমি যখন রেডিওতে কাজ শুরু করি, লিমার রেডিও সেন্ট্রাল- এ সিরিয়াল লিখতো এমন একজনরে আমি চিনতাম। সে বাস্তব এক চরিত্র যে এক ধরণের স্ক্রিপ্ট মেশিনের কাজ করতো: অবিশ্বাস্য অনায়াসে সে অজস্র এপিসোড লিখে যাইতো, এমনকি কী লিখছে সেইটা বেশিরভাগ সময় দুইবার পড়তোও না। লোকটারে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, খুব সম্ভব সে আমার দেখা প্রথম পেশাদার লেখক বলে। তবে যেই বিষয়টা আমারে চমকাইতো সেইটা হইতেছে দুনিয়ার অনেক কিছু ভোজবাজির মতো তার চোখ এড়ায়ে যাইতো; আর সে আমারে চুম্বকের মতো টানতে শুরু করে যখন বইয়ের পেদ্রো কামাচোর মতো কান্ডকারখানা সে করতে শুরু করে।

একদিন, তার লেখা গল্প তার আগের লেখা গল্পের সাথে মিলেমিশে যায় এবং রেডিও শ্রোতাদের কাছ থেকে চিঠি পায় যেখানে শ্রোতারা কিছু অসামঞ্জস্যের কথা জানায় যেমন– তার এক কাহিনীর চরিত্রেরা উড়াধূড়া অন্য কাহিনীতে ঢুকে পড়তেছে। এই ঘটনা আমারে আন্ট জুলিয়া এন্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার উপন্যাসের আইডিয়াটা দেয়। অবশ্যই, উপন্যাসের চরিত্র অনেক রূপান্তরের মধ্যে দিয়া যায়; তার সাথে মডেলের সম্পর্ক নাই বললেই চলে, বাস্তবের চরিত্রের মাথা কোনোদিন খারাপ হয় নাই। আমার ধারণা, সে রেডিওর চাকরিটা ছাইড়া দেয়, ছুটি নেয়… তার এন্ডিংটা উপন্যাসের চাইতে অনেক কম নাটকীয়।

ইন্টারভিউয়ার: বার্গিটাস, যার মধ্যে আপনার ছায়া আছে, কামাচোর সিরিয়াল ক্যারেক্টারদের মতো প্রহসনের জীবন যাপন করে— এই অর্থে উপন্যাসটায় কী এক ধরণের মেটা-ল্যাঙ্গুয়েজ আছে না?

ইয়োসা: কথা সত্যি। আন্ট জুলিয়া লেখার সময়, ভাবছিলাম আমি খালি পেদ্রো কামাচোর কাহিনীটা বলতে যাইতেছি। উপন্যাসের গভীরে যখন ঢুকে পড়ছি, তখন বুঝতে পারি যেএইটা তো একটা বাঘবন্দী খেলায় রূপ নিতেছে এবং খুব একটা বিশ্বাসযোগ্যও হবে না। আগেও যেমনটা বলছি, আমার রিয়ালিজম-ম্যানিয়া টাইপ আছে। ফলে পেদ্রো কামাচোর কাহিনীর এবসার্ডিটির কাউন্টারপয়েন্ট হিসাবে, আমি ঠিক করলাম আরেকটা রিয়ালিস্টিক ক্যারেক্টার তৈরি করবো যা উপন্যাসটারে বাস্তবের দিকে আগায়ে নিবে। যেহেতু আমি নিজেই তখন সোপ অপেরা ধরণের জীবন যাপন করতেছিলাম— আমার প্রথম বিয়া— ফলে ফ্যান্টাসির দুনিয়া ও ডকুমেন্টারি-সুলভ দুনিয়ার মধ্যে একটা টানাপোড়েন তৈরি করতে ঐ এবসার্ড কাহিনীর সাথে আমি একটু ব্যাক্তিগত কাহিনী যুক্ত করলাম। এইটা অর্জন করতে গিয়া আমি বুঝতে পারি যে ফিকশন লেখার সময় এইটা করা অসম্ভব, রচয়িতার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবাস্তবের ইশারা কোনো না কোনোভাবে ঢুইকা পড়েই। ব্যক্তিগত কাহিনীটাও অন্যটার মতো টালমাটাল হয়ে পড়লো। ফলে বার্গিটাসের কাহিনীতে আত্মজৈবনিক উপাদান কিছু আছে বটে কিন্তু সেইটা ফিকশনের ছোয়াচ লাইগা গভীরভাবে বদলায়ে যাওয়া জিনিস।

ইন্টারভিউয়ার: ইদানিংকার বেশ কয়েকটা আর্টিকেলে, আপনি কিছু কথা বলছেন যা নিরাশাবাদী মনে হয়। যেমন, ১৯৮২ সালে আপনি লেখছেনঃ ‘সাহিত্য রাজনীতির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। লেখকদের পলিটিক্সে যুক্ত হওয়া উচিৎ খালি তখনই যখন সে বিপজ্জনক ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে এবং সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়।’ এইটা প্রগতি আনতে রাজনীতির ভূমিকারে খুব নিরাশাজনক নজরে দেখা হয় না?

ইয়োসা: না। আমি বুঝাইছি যে, পলিটিক্স যা করে সাহিত্য তার চাইতেও দীর্ঘস্থায়ী বিষয়ের মামলা, একজন লেখক পলিটিক্স আর সাহিত্যরে একই সমতলে রাখতে পারে না, সেইটা করতে গেলে লেখক হিসেবে এবং হয়তো পলিটিশিয়ান হিসাবেও সে ব্যর্থ হয়। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, পলিটিকাল একশন ক্ষণস্থায়ী, বর্তমানের সাপেক্ষে কিন্তু সাহিত্য স্থায়ীত্বের দাবি নিয়া হাজির হয়। খালি আজকের জন্যে আপনি একটা বই লেখেন না; কোনো রচনারে ভবিষ্যতের উপরে ভূমিকা রাখতে হইলে, সময়েরও ভূমিকা সেইখানে থাকে, যা কখনও — বা হইলেও বিরল— রাজনৈতিক এ্যাকশনের বিষয় না। অবশ্য, এইটা বললেও, রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়া আমি মন্তব্য করা কখনও বন্ধ করি না, বা আমার নিজের লেখা ও কাজের ক্ষেত্রে নিজেরে সেই রাজনীতি থেকে দূরেও রাখি না। আমার বিশ্বাস, একজন লেখক পলিটিকাল অবস্থারে এড়াইতে পারে না, বিশেষভাবে আমাদের মতো দেশে যেখানে সমস্যা অনেক জটিল, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির নানান নাটকীয় দিক থাকে।

সমালোচনা, আইডিয়া দিয়া, সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখতে তার কল্পনাশক্তিরে কাজে লাগানো একজন লেখকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ ও ব্যক্তির জন্যে স্বাধীনতার গুরুত্ব লেখকের তুলে ধরা খুব দরকারী— কারণ সকল শিল্পীর মতোই, তারা এইটা গভীরভাবে টের পায়। ন্যায়বিচার, যা আমরা সবাই চাই সমাজ শাসন করুক— কখনও স্বাধীনতার ধারণা থেকে আলাদা হওয়া উচিৎ না; এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বা জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে মাঝেমধ্যে স্বাধীনতারে কুরবানি দেওয়া লাগতে পারে— যেমনটা উগ্র বামপন্থি টোটালিটারিয়ানরা ও উগ্র ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল যেইটা আমাদের বিশ্বাস করাইতে চায়— এই ধারণা কখনওই আমাদের মাইনা নেওয়া উচিৎ না। লেখকেরা এইটা জানে কারণ প্রতিটি দিন তারা টের পায় সৃষ্টির জন্যে, জীবনের জন্যে স্বাধীনতা কতটা দরকারি। কাজের অধিকার বা ন্যায্য মজুরির অধিকারের মতো মৌলিক অধিকার হিসেবে লেখকদের উচিৎ তার স্বাধীনতারে ডিফেন্ড করা।

ইন্টারভিউয়ার: কিন্তু আমি আপনার কথাটারে কোট করলাম পলিটিক্স কী করতে পারে সেই ব্যাপারে নিরাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টা তুলে ধরতে। লেখকদের কি বিরোধিতাতেই নিজেদেরকে সীমিত রাখা উচিৎ নাকি রাখতে পারে?

ইয়োসা: আমার বিশ্বাস, লেখকের দরকার অংশগ্রহণ, জাজমেন্ট দেওয়া বা ইন্টারভেন করা, একইসাথে পলিটিক্স তার সাহিত্যের ময়দানে, তার সৃজনশীলতার জগতে আইসা হামলায়ে পড়বে আর ধ্বংস করবে এইটাও ঘটতে দেওয়া উচিৎ না। তেমনটা ঘটলে, লেখকের মরন হয়, সে প্রোপাগান্ডিস্টের বাইরে কিছু হয় না। ফলে রাজনীতিরে একদম অচ্ছুত না বানায়ে বা মতামত দেওয়া থেকে দূরে না থাইকাও, পলিটিকাল এক্টিভিটিজে তার এক ধরণের সীমানা টানাটা জরুরি।

ইন্টারভিউয়ার: যে লেখক সারাজীবন পলিটিক্সের ব্যাপারে অনেক অবিশ্বাস দেখাইছে সেই লেখকই কেমনে ১৯৯০ সালে পেরুর জাতীয় ইলেকশনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়?

ইয়োসা: একটা দেশ কখনও এমন জরুরি অবস্থায় নিজেরে পাইতে পারে, যেমন যুদ্ধের সময়, তখন আর কোনো বিকল্প থাকে না। আজকে পেরুর পরিস্থিতি বিপর্যয়কর। অর্থনীতি ধুকতেছে। মুদ্রাস্ফীতি সব রেকর্ড ভেঙে ফেলতেছে। ১৯৮৯ সালের প্রথম দশ মাসে মানুষ তার ক্রয়ক্ষমতার শতকরা ৫০ ভাগ হারাইছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করছে। চমকপ্রদ ব্যাপার হইতেছে, এই বিশাল সংকটের মধ্যেই, দেখা যায় গণতন্ত্রের দিকে বৈপ্লবিক রূপান্তর ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সম্ভাবনা। ১৯৮৬ সাল থেকে পেরুতে চলে আসা সামষ্টিক, সমাজতান্ত্রিক যে রাষ্ট্রীয় মডেল চলে আসতেছে, আমরা সেইটা পুনর্বিবেচনা করতে পারি। বিগত বছরগুলিতে যার জন্যে আমরা সংগ্রাম করছি সেই লিবারেল রিফর্ম ও প্রকৃত বাজার অর্থনীতি সৃষ্টির এই সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করা উচিৎ না।
বর্তমানে দেশটাতে সংকটের পেছনে দায়ী পলিটিকাল কালচারের সংস্কারের কথা আর নাই বললাম। এইসব কারণ আমার আগের মনোভাব বদলাইতে বাধ্য করছে এবং আমারে রাজনৈতিক সংগ্রামে জড়ায়ে ফেলছে—যদিও এইটা খুব সরলমনা বিভ্রমই হয়তো।

ইন্টারভিউয়ার: লেখক হিসেবে আপনার বড় শক্তি আর দূর্বলতা কী মনে করেন?

ইয়োসা: আমি মনে করি, লাইগা থাকতে পারা আমার সবচে বড় গুণ। আমি কঠিন পরিশ্রম কইরা যাইতে পারি, নিজের ভিতর থেকে যতটুকু সম্ভব তার চাইতেও বেশি বাইর কইরা আনতে পারি। আমার সবচাইতে বড় দূর্বলতা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, যা আমারে ব্যাপক প্যারা দেয়। একটা উপন্যাস লেখতে আমার তিন-চার বছর লাইগা যায়—আর এর মধ্যে একটা বড় সময় আমার কাটে নিজেরে সন্দেহ কইরা। সময়ের সাথে সাথে অবস্থার কোনো উন্নতিও হয় না; উলটা দিন যত যাইতেছে মনে হয় নিজের ব্যাপারে আরও ক্রিটিকাল আর আরও কম আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতেছি। হয়তো এই কারণেই আমার কাজ একদম বিফল না: আমার বিবেক অনমনীয়। কিন্তু আমি জানি মৃত্যের আগ পর্যন্ত আমি লিখা যাবো। লেখা আমার নেচারে আছে। আমি আমার কাজের প্রয়োজনে বাচি। সন্দেহের লেশমাত্র নাই যে, লিখতে না পারলে আমি হয়তো গুলি করে আমার মগজ উড়ায়ে দিতাম। আমি আরও অনেক বই লিখতে চাই, আরও ভালো বই লিখতে চাই। যা পাইছি তার চাইতেও মজার ও চমকপ্রদ সব এডভেঞ্চারের দেখা আমি পাইতে চাই। আমার সেরা সময়টা চলে গেছে এইটা আমি স্বীকার করতে চাই না, এমনকি চোখের সামনে প্রমাণ হাজির করা হইলেও আমি সেইটা করতে চাই না।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি লেখেন কেন?

ইয়োসা: আমি লেখি কারণ আমি অসুখি। লেখি কারণ লেখা অ-সুখরে ফাইট করার একটা উপায়।

—স্প্যানিশ থেকে সুসান্নাহ হানওয়েলের তর্জমা

[বইটা অক্টোবর, ২০২৩-এ বাছবিচার বুকস থিকা ছাপানো হবে।]

Series Navigation<< একটা নভেলে যদি লিটেরারি ট্রুথ থাকে ওইটার আর কিছু লাগে না – এলেনা ফেরান্তেআপনার যেইটা বলা লাগবে সেইটাই আপনার ফর্মটা ঠিক করে দিবে – ডোরিস লেসিং >>
The following two tabs change content below.

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →