Main menu

ঢাকা ডায়েরি (১৬.১২.২০২২)

ঢাকা শহরে পথে ঘাটের মানুষদের ভদ্রতা-জ্ঞানের অভাব, অথবা রুড (rude) আচরণ – এটা সর্বদাই মজার একটা আলোচনার বিষয় এবং এই নিয়ে আগেও দু একবার গদ্য রচনা করছিলাম ফেবুতে । আজকে আবার। কাকতালীয় ভাবে আজকে সারাদিনই এই রিলেটেড নানা কর্মকাণ্ড চলতেছে।

.
সকালে উঠেই মনে পড়ে ঢাকা ইউনি-তে পড়া কালীন হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিলেটেড একটা কোর্সে নানারকম উন্নয়ন তত্ত্ব নিয়ে শিক্ষক আলোচনা করতেছিলেন আর তাদের মধ্যে একটা তত্ত্বে অনেকটা এইরকম কথা ছিল যে – (ভিনদেশী সেই তাত্ত্বিক বলতেছিলেন) – উন্নতির একেকটা পর্যায় একটা সোসাইটিতে (অথবা যেকোনো প্রতিষ্ঠানে, যেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে) মানুষের আচরণ একেকরকম হয়। উনি বলতেছিলেন, উন্নতির এই দৌড়ে মধ্যম পর্যায় যারা থাকেন – তাদের আচরণ হয় সবচেয়ে বেশি রুড। তারা হন নিষ্ঠুর, বদমেজাজী, অধীনস্তদের চাপের উপরে রাখেন, টেনশন করেন বেশি – এইসব। আবার, যারা পর্যাপ্ত উন্নতি করে ফেলছেন, অর্থাৎ সবচেয়ে উপরের শ্রেণীতে থাকেন, অর্থে বিত্তে সম্মানে যাদের অভাব নাই, তাদের আচরণ হয়ে উঠে মধুর এবং ভদ্র।

.
তো, সকালে উঠেই এই তত্ত্ব-জাত কথাগুলি মনে হচ্ছিল আর ভাবেতছিলাম, বাংলাদেশ নিশ্চই এতদিনে মধ্যম পর্যায় উন্নীত হয়ে গেছে। এটাই তার প্রমাণ।

.
এই রুডনেসের মধ্যে নিজের সুস্থতা বজায় রেখে টিকে থাকার জন্য আমার নিজের ব্যক্তিগত টেকনিক (অথবা প্রস্তাবনা) হতেছে একটা মেঠো ঢঙে, সোজা সাপটা ভাষায় কথা বলা। শ্রোতার তাগদ টেনে ধরে কথা বলা । মার্কিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবের কথা বলার স্টাইল নিয়ে একবার শুনছিলাম এইরকম যে, উনার এই ছোটো ছোটো বাক্যে, ‘র’ বা কাচা ঢঙে কথা বলার স্টাইলটা নাকি আরও বেশ কিছু সফল ব্যবসায়ী, প্রশাসক আর রাজনীতিবিদের মধ্যে দেখা গেছে। মানুষের সাথে কমিউনিকেট করে ভালো। রুচিশীলতার বিচারে যতই খারাপ হোক না কেন, এর ফলাফল কিংবা কার্যকারীতা বেশি। আমার ধারণা, এর সাথে যদি একটু রসিকতা মিলায়ে দেয়া যায় তাইলে ফলাফল আরও ভালো।

.
আজকে এক উচ্চ বা উচ্চমধ্যবিত্ত ক্লায়েন্ট মণ্ডলীদের জন্য নির্মিত চুল কাটার সেলুনে গেলাম। চুল কাটার দাম ভালোই রাখে এরা, অন্য অনেক স্থানের চাইতে বেশি, ঢাকা শহরে ইনাদের একাধিক শাখা আছে। আমি এইরকম কিছু কিছু স্থানে মাঝে মাঝে হানা দেই (সম্ভব হলে) শহরের হাল চাল বোঝার জন্যে। তো দেখলাম সুসজ্জিত, স্মার্ট নাপিত ব্যক্তিটি মুখে মুখে স্যার-স্যার বলতেছেন ভালো, কিন্তু লক্ষ্য করলে বোঝা যায় উনার হাবে ভাবে ভদ্রতার কিরকম যেন একটা অভাব। চুল কাটতে বসার পরে রুক্ষ ভাবে পিছন থেকে মাথা ঠেলে দেয়, হঠাৎ করে ডানে থেকে কোনো কথা না বলে আঙুলে জোরে ঠেলে দিল একবার, মাথাকে পজিশনে আনার জন্য। অনেক ইটালিয়ান সেলুনের (ইটের উপরে বসা সেলুন) নাপিতেরাও উনার চেয়ে ভদ্র হয়ে থাকেন সচরাচর।

.
তো এইরকম দুই একবার ‘আৎকা’ ঠেলা খাওয়ার পরে আমি সরাসরি থ্রেট দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠলাম, “কি মিয়া এইরকম গুতা দেন কেন?”। তো এরকমের বড়লোক-ঘেষা সুশীল একটা পরিবেশে ‘গুতা’ শব্দটা শুনে সে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বলে উঠে, কই স্যার না, আমি তো …। আমি বলি অবশ্যই আপনে গুতা দিছেন, পিছন দিয়া একবার, এই ডানে থেকে এখন একবার। তো এইরকম বলার কিছুক্ষণ পরে থেকে দেখি তার মাথা হ্যান্ডেল করার কায়দা অনেক মোলায়েম আর ভদ্র হয়ে উঠেছে। খুব তকলিফের সাথে উনি চুলকাটা হ্যান্ডেল করা শুরু করলেন। এক ফাঁকে সামান্য হাসিও হাসছেন বলে মনে হলো। সবই ঐ ‘গুতা’ শব্দের কারিশমা। তো এই ধরণের কায়দা আমার মনে হয় কাজে দেয়। । এইটা অভদ্রতা নয়, বরং খুব ‘র’ বা কাচা ভাবে একজন অপরিচিত মানুষের সাথে কমিউনিকেশন স্থাপন করা। নিজের চাহিদা বা দাবীটা স্পষ্ট ভাবে জানানো।
.

এর বদলে [অর্থাৎ, নাপিত তরুণের সাথে ‘র’ ভাষায় কথা বলার বদলে] কী করা যেতে পারত। একজন ভদ্র মানুষ সাধারণত যা যা করে থাকেন সেইগুলি এই ক্ষেত্রে ইনেফেকটিভ, বা নিস্ফলা হতো। আমি যদি সেই সেলুনে যাওয়া বন্ধ করে দেই, তাইলে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমার মতো পঞ্চাশ জন ব্যক্তিও যদি ঐ সেলুনে যাওয়া বন্ধ করে দেয় তাইলেও কোনো ক্ষতি নাই। আরও পনের শ জন ক্লায়েন্ট আছেন যারা যাবেন। ঢাকা শহরে লোকসংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এখন আর কাস্টমারের মন রক্ষা করে চলা লাগে না। পঞ্চাশ জন ক্লায়েন্ট না হলে সমস্যা নাই, আরও পনের শ জন আছেন, যেখানে দেড় শ জন হলেই তার ব্যবসা ভালো মতো চলে যায়। ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেইন করা যেতে পারত (একজন ভদ্রলোকের স্বাভাবিক রি-একশন)। সেটাতেও লাভ আছে বলে মনে হয় না। আমি দোকান থেকে বের হবার পরে পরেই সেই ম্যানেজার ঐ কর্মী সহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে হাসাহাসি করে এক চোট নিয়ে নিবেন। এইরকম আমি নিজে একটা বিরিয়ানীর দোকানে বসে দেখছি।

.
কাকতালীয় ভাবে সারাদিনই আজকে বিষয়টা ঘুরে ফিরে আসতেছে। সন্ধ্যায় আরেকটা ফেবু পোস্টে এই রিলেটেড বিষয়ে মন্তব্য করলাম। আবার দুপুরবেলায় হুমায়ুন আহমেদের বহু আগে লেখা একটা বই (বহুব্রীহি) রি-রিড করার সময় এই বিষয়ে মন্তব্য পাইলাম। হুমায়ুন আহমেদ অবশ্য ভালো মানুষ আছেন। উনি খুব মায়াময় দৃষ্টি দিয়ে দেশবাসীকে বিচার করেছেন । বাঙালির ক্রমবর্ধমান রুডনেস নিয়ে উনি কয়েক বছর আগেই লিখে গেছেন দেখলাম:

.
“দুপুরে খাবার পরে ফরিদ টানা ঘুম দেয়। বাংলাদেশের জল হাওয়ার জন্যে এই ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন বলে তার ধারণা। এতে মেজাজের উগ্র ভাবটা কমে যায় — স্বভাব মধুর হয়। ফরিদের ধারণা জাতি হিসাবে বাঙালি যে ঝগড়াটে হয়ে যাচ্ছে তার কারণ এই জাতি দুপুরে ঠিক মতো ঘুমুতে পারছে না। …”

.
তো শেষমেশ এটাই আমারও conclusion। ঢাকা শহরের মানুষদের মধ্যে ভদ্রতা আর মধুরতা ফিরিয়ে আনতে হলে তাদেরকে দুপুরে ঠিকমতো ঘুমানোর সুযোগ দিতে হবে। এটাই এখন একমাত্র দরকার। সব প্রতিষ্ঠানের অফিসের পিছনে কর্মীদের জন্য দুপুরে ঘুমের ব্যবস্থা রাখা দরকার।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রাদ আহমদ

কবি। ফ্রিল্যান্স প্রোগ্রামার। থাকেন ঢাকায়।
Avatar photo

Latest posts by রাদ আহমদ (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →