ও পোলা, ও পোলা রে–ও মাইয়া, ও মাইয়া রে

‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম…’–হৈমন্তি শুক্লাদের কওয়ার কিছু কেন থাকে না? এনারা তো ‘বিশ্ব সাহিত্য’র লোক, কত কত দেশের কবিতা বা কেচ্ছা-কাহিনি খাইছেন এনারা, বানাইছেন কত কোটি কোটি শব্দের আর্ট-কালচার, কেন তবু এনারা কইবার কিছু পাইতেছেন না!
উল্টাদিকে, আরমান আলিফ বা মমতাজরা একই টাইপের ঘটনায় কত কি কইতেছেন! মমতাজদের বুকটা ফাইট্টা যায়, আলিফ কইতেছেন–ও মাইয়া, তুই অপরাধী রে!
হৈমন্তি শুক্লাদের ছাইড়া যাওয়া নাগরেরা নাগালের বাইরের কোন ‘ভালো’, ইনকম্প্যাটিবল বেটার; আলিফ বা মমতাজদের ছাইড়া যাওয়া নাগরেরা বেঈমান, পাপী, নেমকহারাম; খারাপ লোক এরা, তাই ভালো ছাইড়া গেছে!
হৈমন্তিরা যেন নেচারাল সিলেকশনে বাদ পড়তেছেন, বেটারের দিকে যাইতেছে তাগো নাগরেরা, সোনাবন্ধুর ছাইড়া যাওয়ায় হৈমন্তিরা স্যাড, নিজেদের ইনফিরিয়রিটি মালুম হইলো বইলা ডিপ্রেসড, কম্পিটিশনে ডাব্বা মারছেন এনারা, ‘বিশ্ব সাহিত্য’ তাগো মুখে বুলি দিতে পারতেছে না! আহা!
কিন্তু ‘ও মাইয়া, তুই অপরাধী রে…’ কইতেছেন আলিফ, টুম্পা খান নামে এক মাইয়া জবাব দিছেন, ‘ও পোলা, তুই অপরাধী রে…’। হৈমন্তিদের তুলনায় টুম্পা বা আলিফ বা মমতাজরা ভাবে পুরাই উল্টা! গানের কথার বাংলায় নজর দিলে দেখবেন, হৈমন্তিরা কোলকাতাই বাংলার কালচার্ড মিডল ক্লাস ধনী, টুম্পা-আলিফরা আম জনতার কমন বাংলার কমন গ্রাউন্ডের লোক, ক্লাসের সীমায় বন্দী নাই।
দেখা যাইতেছে, টুম্পাদের ইনফিরিয়রিটি নাই, হৈমন্তিদের মতো! এদের বিরহ আছে, দুঃখ আছে, ডিপ্রেশন নাই! আম বাংলায় বৈরাগিরও ডিপ্রেশন নাই, বরং মুক্ত আজাদ!
‘আধুনিক’ গানের লগে বাংলার আমজনতার গানের এই এক গোড়ার তফাত! কিন্তু বাংলার ‘আধুনিকতা’ কেন এমন ডিপ্রেসড? এইটা কলোনিয়াল আমদানি, এই কি কারণ! ‘আধুনিকতা’ মানেই কি এমন ডিপ্রেসড? আমার ধারনা, ‘মডার্নিটি’র একটা নেসেসারি ফিচার ডিপ্রেশন হইলেও, কলোনিয়াল কোলকাতার মতো মডার্নিটি এতো কামিয়াব হয় নাই আর কোথাও!
কেননা, সমাজে অনেক ভাবনাই একই জামানায় একটিভ থাকে, জামানার নামগুলা যুদা হয় মাতবর ভাবনার হিসাবে; যে জামানায় যেই ভাবনা মাতবর হইয়া ওঠে, সে সরদারি কইরা নিজের নামে জামানার নাম দিয়া দেয়! কলিকাতায় মডার্নিটি মাতবর হইয়া উঠলো কলোনিয়াল ইংরাজের কোলে বইসা, কিন্তু এইটা কামিয়াব হবার পিছে লোকাল কিছু ব্যাপার মদদ দিছে!
কইতেছি আর্যামীর কথা; জীবনানন্দ দাশে খেয়াল করেন, বনলতা সেন বা অরুণিমা স্যানালে মনে হইতেছে কাস্ট মিলানো পিরিতের ইশারা (স্যানাল মনে হয় বামুন, তবে তার মুখ মনে পড়তো দাশের, তারচে বেশি কিছু না ) ! ব্রাহ্ম হবার পরেও সাহস পাইতেছেন না দাশ! সুরঞ্জনা হয়তো মুখার্জী আছিলেন, নামের মাঝে রঙের খবরও আছে একটু; তাই হয়তো সুরঞ্জনার পদবী আর রাখার সাহস পান নাই জনাব দাশ! আরো পরে বিনয় মজুমদার এক চক্রবর্তীতে কেমন ইনফিরিয়র! মধুসূদন কাস্টে সুবিধা করতে না পাইরা খৃস্টান হইলেন!
কাস্টের ব্যাপারে আন্দাজ হইলো, আর্য বামুন আর ক্ষত্রিয় ফর্সা, বাকিরা কালাই গড়ে; আর্যের এই রঙের দেমাগ কালাদের মন ইনফিরিয়র কইরা রাখতে চায়, তারা কামিয়াবও ইন জেনারেল, সেইটা এখনো দেখতেছেন পাউডার মাখার ঘটনায় বা অপো/স্যামসাং ক্যামেরার ফিল্টারে।
ইংরাজে ইনফিরিয়র মন আর পোক্ত ইনফিরিয়র হয় এই কাস্টের সীমার কানুনে! ইংরাজের মদদে আর্য না হইয়াও জমিদার হইতেছে, ইংরাজির ছবকে কলোনিয়াল কেরানি বা জজও হইতেছে, কিন্তু কাস্টের সীমা ডিঙাইতে পারতেছে না; এই কাস্ট এমনকি ইংরাজের রেসিজমের চাইতেও মজবুত; মধুসূদণ খৃস্টান হইয়া হোয়াইট মাইয়া বিয়া করতে পারলো, কিন্তু হিন্দু থাইকা কাস্ট ডিঙাইতে পারেন নাই!
কলোনি, রেসিজম আর কাস্টের এই কঠিন মজবুত সীমানার ভিতরে থাইকা কলিকাতা যখন মডার্ন ডিপ্রেশনের ছবক পায়, সেইটা আর সব দেশ-মানুষের তুলনায় কামিয়াব হইয়া উঠতে পারে! একটা আরেকটারে মদদ দিতে থাকে!
কিন্তু আমজনতার মাঝে ঐ মডার্নিটি ততো ঢুকতে পারে নাই; কলোনিয়াল ছবক পুরা লয় নাই আম বাংলা, আবার মোসলমান বা বোস্টমদের মাঝে কাস্টের অমন চাপ আর দেমাগ ততো নাই, ডিঙাইতে পারে প্রায়ই! খেয়াল করলে দেখবেন, মনুসংহিতা মানা হিন্দুরা এখনো নিজেদের নামে পদবী রাইখা জানায় কাস্টের খবর, বোস্টম বা মোসলমানদের মাঝে পদবী ততো নাই; থাকলেও সেইটা ক্লাস আর বনেদিয়ানার দেমাগ, কখনো বা মিডল ইস্টের লগে শিকড়ের রিশতা, কিন্তু কাস্টের সীমার মতো হারাম ব্যাপার না ততো! পদবীর লগে রঙেরও ততো ঘন রিশতা পাইবেন না!
হৈমন্তিদের ইনফিরিয়রিটির গোড়ায় এইসব কাহিনি আছে, তাই তারা কথা পায় না মুখে, কিন্তু মমতাজ-আলিফ-টুম্পারা গলার জোর পুরাটা দিয়া গালি দিতে পারে, ‘বেঈমান’!
২.
ও মাইয়ার’ জবাবে ‘ও পোলা…’। বাংলার ‘ডেসপাসিতো’ মনে হইতেছে, ভাবে না ভাইব্রেশনে, ডান্স মিসিং অবশ্য, ভাইব্রেশন ঠিক শরীলের না ডেসপাসিতো’র মতো…
কিন্তু আবারো আপনেরা যেইটা মিস করতেছেন– এই লিরিকের বাংলা! বুঝতে রাজি হওয়া উচিত আপনাদের, আম/কমন বাংলার এতো কাছে না গেলে আপনাদের আর্ট-কালচারের ভাইব্রেশন ছায়ানটী কুয়ার বাইরে যাইতে পারবে না… ‘ভাষা প্রতিযোগ’ টাইপের চিটিংবাজি দিয়া কাম হবে না !
৮জুন ২০১৮
আরো পড়েন::

রক মনু

লেটেস্ট ।। রক মনু (সবগুলি)
- এডিটোরিয়াল: শাসনের মুসাবিদা - জানুয়ারী 10, 2019
- পোস্টস্ক্রিপ্ট: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য কবিতা নিয়া - ডিসেম্বর 4, 2018
- ফিকশন: দেনা পাওনা (পার্ট ১) - জুলাই 16, 2018