Main menu

পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।। সৈয়দ মুজতবা আলী।। কিস্তি ৩।।

কিস্তি ১ ।। কিস্তি ২।।


এই পোস্ট’টা পড়া আগে আগের দুইটা কিস্তি পইড়া নিলে ভালো। কারণ এইটা একটা লেখারই কন্টিনিউয়াস পার্ট। আর পড়ার সময় লেখার কনটেক্সট’টা মাথায় রাখতে পারলে বেটার। সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৪৭ সালে ভাষণ দেয়ার পরে ১৯৫৬ সালে বই হিসাবে ছাপাইছিলেন, লেখাটা। বাংলা-ভাষা নানান সময়ে নানান তর্কের ভিতর দিয়া গেছে। এইটা এইরকম একটা মোমেন্টের কথা। অই সময়টা আমরা পার হয়া আসছি। কিন্তু পার হয়া আসছি বইলাই অই আলাপ-আলোচনাগুলারে ভুইলা যাওয়াটা ঠিক হবে না। বরং এখনকার যেই বাংলা-ভাষা সেইটার বেইজ এইরকমের আলাপগুলাই। যেইগুলা আমরা আসলে আমলে নিতে পারি নাই, বা  নতুন কইরা রিলিভেন্ট কইরা তুলতে পারি নাই। এই কারণে এই ধরণের লেখাগুলা রিভিউ করার দরকার আছে। আবারো ছাপাইতেছি আমরা।

ই. হা.

এ দেশে যে ইসলামি শিক্ষা কখনো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে নি তার প্রধান কারণ বাংলার মাধ্যমিকে কখনো শাস্ত্রচর্চা করা হয় নি। যে বস্তু মাতৃভাষায় অতি সহজ, অত্যন্ত সরল, বিদেশী ভাষায় সেই বস্তুই অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন আরম্ভ হয় স্কুল থেকে পালানোর পালা এবং মধ্যবিত্ত ও ধনীর গৃহের চাপের ফলেই এই দুই শ্রেণীর ছেলে তখনো লেখাপড়া শেষে, কিন্তু অনুন্নত গরীব তখন ভাবে যে পরিবারে যখন কেউ কখনো লেখাপড়া শেখে নি তখন এ ছেলেই বা পারবে কেন, বাপ-দাদার মত এরো মাথায় গোবর ঠাসা।

মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষা দিলে যে দেশের কতদূর ক্ষতি হয় তার সামান্যতম জ্ঞান এখনো আমাদের হয় নি। সে শিক্ষাবিস্তারে যে তখন শুধু অজস্র অর্থব্যয় হয় তা নয়, সে শিক্ষা ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তিকে অবশ করে তোলে, কল্পনাশক্তিকে পঙ্গু করে দেয় এবং সর্বপ্রকার সৃজনী-শক্তিকে কণ্ঠরোধ করে শিক্ষার আঁতুড় ঘরেই গোরস্থান বানিয়ে দেয়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি—আমার অভিজ্ঞতা কলেজের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরূপে অর্জিত—যে পশ্চিমভারতের কার্ভে স্ত্রী-মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যদিও দু’এক দিক দিয়ে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের চেয়ে পশ্চাৎপদ তবু স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা যেমন তাদের বেশী তেমনি প্রকাশ ক্ষমতা, আত্মপরিচয় দানের নৈপুণ্য তাদের অনেক বেশী। তার একমাত্র কারণ কার্ভে স্ত্রী-মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আপন আপন মাতৃভাষার মাধ্যমিকে লেখাপড়া করে আর বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা লেখাপড়া শেখে ইংরেজীর মাধ্যমিকে। কার্ভের মেয়েরা সেই কারণে আপন মাতৃভাষায় নিঃসঙ্কোচে অবাধ-গতিতে আপন বক্তব্য বলতে পারে, বোম্বাই, কলিকাতা, ঢাকার ছেলেরা না পারে বাংলা লিখতে, না জানে ইংরেজী পড়তে।

এ-কাহিনীর শেষ নেই কিন্তু আমাকে প্রবন্ধ শেষ করতে হবে। তাই পাঠককে সবিনয় অনুরোধ করি তিনি যেন শিক্ষা বিভাগের কোনো পদস্থ ব্যক্তিকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন। শ্রীহট্টের খ্যাতনামা আলিম মৌলানা সখাওতুল আম্বিয়া প্রমুখ গুণীগণ আমার সম্মুখে বহুবার স্বীকার করেছেন যে মাদ্রাসাতে যদি বাংলা ভাষা সর্বপ্রকার বিষয় শিক্ষার মাধ্যমিক হত তবে আমাদের আরবী-ফার্সীর চর্চা এতদূর পশ্চাৎপদ হত না। এবং কৌতুকের বিষয় এই যে, উর্দুওয়ালারা বাংলাকে এত ইনকার-নফরৎ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন তাঁদেরও অনেকেই কঠিন বিষয়বস্তু যখন উর্দুতে বোঝাতে গিয়ে হিম্‌সিম্ খেয়ে যান তখন নোয়াখালী, সিলেটের গ্রাম্য উপভাষারই শরণাপন্ন হন।

এত সরল জিনিস উর্দুওয়ালাদের কি করে বোঝাই? কি করে বোঝাই যে পারস্যের লোক যখন ফার্সীর মাধ্যমিকে আরবী (এবং অন্যান্য তাবৎ বিষয়) শিখবে। উর্দুর মাধ্যমিকে কোন আজগুবী কাণ্ডজ্ঞানহীনতার তাড়নায়?

এ প্রসঙ্গের উপসংহারে শেষ কথা নিবেদন করি, মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিক না করলে সে ভাষা কখনো সমৃদ্ধিশালী হবার সুযোগ পায় না।

স্বরাজ এলো পাকিস্তান হ’ল কিন্তু হায়, গোস্বামী খাসলৎ (মনোবৃত্তি ও আচার ব্যবহার) যাবার কোনো লক্ষণ তো দেখতে পাচ্ছিনে। এতদিন করমপুর ইংরেজীর গোলামী, এখন স্বেচ্ছায় বরণ করে নিচ্ছি উর্দুর গোলামী। খতম আল্লাহু আলা কুপুবিহিম ইত্যাদি। খুদাতালা তাদের বুকের উপর সীল এঁটে দিয়েছেন। (কুরান থেকে এ অংশটুকু এখানে উদ্ধৃত করার কোনো প্রয়োজন হ’ত না, যদি কোনো কোনো ‘মৌলানা’ বাংলা ভাষার সমর্থকদের ‘কাফির’ হয়ে যাওয়ার ফতোয়া না দিতেন)।

এইবার দেখা যাক্, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সরকারী ও সংস্কৃতিক ভাষারূপে গ্রহণ করতে উর্দুওয়ালাদের আপত্তিটা কি? তাঁদের প্রধান আপত্তি, বাংলা ‘হেঁদুয়ানী’ ভাষা। বাংলা ভাষায় আছে হিন্দু ঐতিহ্য, হিন্দু কৃষ্টির রূপ। পূর্ব পাকিস্তানী যদি সে ভাষা তার রাষ্ট্র ও কৃষ্টির জন্য গ্রহণ করে তবে সে হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যাবে।

উত্তরে নিবেদন, বাংলা ভাষা হিন্দু ঐতিহ্য ধারণ করে সত্য, কিন্তু এইটেই শেষ কথা নয়। বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

বুদ্ধদেব যে রকম একদিন বৈদিক ধর্ম ও তার বাহন সংস্কৃতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন দেশজ ভাষায় (পরে পালি নামে পরিচিত) আপন ধর্ম প্রচার করেন, ঠিক সেই রকম বাংলা ভাষার লিখিত রূপ আরম্ভ হয় বৌদ্ধ চর্যাপদ দিয়ে। পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্য রূপ নেয় বৈষ্ণব পদাবলীর ভিতর দিয়ে। আজ পদাবলী সাহিত্যকে হিন্দু ধর্মের অংশ হিসাবে গণ্য করা হয় কিন্তু যে যুগে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত সে যুগে তাকে বিদ্রোহের অস্ত্রধারণ করেই বেরুতে হয়েছিল। তাই শ্রীচৈতন্য প্রচলিত ধর্ম সংস্কৃতে লেখা হয় নি, লেখা হয়েছিল বাংলায়। সঙ্গে সঙ্গে রামায়ণ মহাভারতের যে অনুবাদ বাংলায় প্রকাশিত হয় তার পেছনে ছিলেন মুসলমান নবাবগোষ্ঠী। কেচ্ছা-সাহিত্যের সম্মান আমরা দি–হিন্দুরা দেন না— এবং সে সাহিত্য হিন্দু ঐতিহ্যের গড়া নয়। এর পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বাংলা গদ্যের পত্তন হয় তার অনুপ্রেরণা খৃষ্টান সভ্যতা থেকে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু বলে স্বীকার করেন কি না, সে কথা অবান্তর—তাঁর অবদান যে উপনিষদ-সংস্কৃতি ও ইয়োরোপীয় প্রভাবের ফলে গঠিত সে কথা অনস্বীকার্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব প্রচলিত নূতন ধারাকে বৈদিক কিংবা সনাতন বলা ভুল, সে ধারা গণ উপাসনার উৎস থেকে প্রবাহিত হয়েছে এবং সে উৎসকে গোঁড়া হিন্দুরা কখনো শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেন নি। স্বামী বিবেকানন্দের ‘জাতীয়তাবাদে’র মূল বেদ উপনিষদ নয়।

উর্দুওয়ালারা বলবেন, ‘এসব খাঁটি হিন্দু না হতে পারে, কিন্তু আর যাই হোক না কেন, ইসলামি নয়।

আমরা বলি, ‘ইসলামি নয় সত্য কিন্তু এর ভেতরে যে ইন্‌কিলাব্ মনোবৃত্তি আছে সেটি যেন চোখের আড়ালে না যায়। এই বিদ্রোহ ভাব বাংলায় ছিল বলে কাজী নজরুল ইসলাম একদিন আপন ‘বিদ্রোহী’ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ‘মরমিয়াপনার’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে যে নবীন কৃষ্টি গঠিত হবে সেটা এই বিদ্রোহ দিয়েই আপন বিজয়-অভিযান আরম্ভ করবে।

এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে আরেকটি কথা বলি: উত্তর ভারতের তাবৎ সংস্কৃত ভাবাপন্ন ভাষার মধ্যে (হিন্দী, মারাঠী, গুজরাতী ইত্যাদি) বাংলাই সবচেয়ে অসংস্কৃত। হিন্দী, মারাঠী পড়বার বা বলবার সময় সংস্কৃত শব্দ খাঁটি সংস্কৃত উচ্চারণে পড়া এবং বলা হয়—‘পরীক্ষা’ পড়া হয়—‘পরীক্ষা’, ‘আত্মা’ পড়া হয় ‘আত্মা’—কিন্তু বাংলায় সংস্কৃত শব্দ, এমনকি সংস্কৃত ভাষা উচ্চারণ করার সময়ও, উচ্চারণ করা হয় বাংলা পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে বাঙালী হিন্দু পর্যন্ত উর্দুভাষী মুসলমানের চেয়ে এককাঠি বাড়া। উর্দুভাষী মুসলমান তার ভাষার সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করে খাঁটি সংস্কৃত কায়দায়, বাঙালী হিন্দু উচ্চারণ করে ‘অনার্য’ কায়দায়।

না হয় স্বীকার করেই নিলুম, বাংলা ‘হেঁদুয়ানী’ ভাষা কিন্তু প্রশ্ন, এই ভাষা এতদিন ধরে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান কি ‘নাপাক’, ‘হিন্দু’ হয়ে গিয়েছে? পাকিস্তান স্বপ্ন সফল করাতে কি পূর্ব পাকিস্তানের ‘না-পাক’ মুসলমানদের কোনো কৃতিত্ব নেই? পাকিস্তান-স্বপ্ন কি সফল হল লাহোর, লক্ষ্ণৌর কৃপায়? পূর্ব পাকিস্তানে যারা লড়ল তারা কি সবাই উর্দুর পাবন্দ আলিম-ফাজিল, মৌলানা-মৌলবীর দল? না তো। লড়ল তো তারা যারা উর্দু জানে না, এবং বাংলার জন্য আজ যারা পুনরায় লড়তে তৈরী আছে। এই সব লড়নেওয়ালারা এত দিনকার ইংরেজ আধিপত্য এবং হিন্দু প্রভাবের ফলেও যখন হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যায় নি, তখন পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলেই তারা রাতারাতি ইসলামি জোশ হারিয়ে পাকিস্তানের শত্রু বনে যাবে? এ তো বড় তাজ্জব কথা? বাংলা ভাষার এত তাগদ?

দ্বিতীয় বক্তব্য আমরা ইতিহাস নিয়ে অরম্ভ করি। পূর্বেই বলেছি, ফিরদৌসীর আমলে ইরানের সর্বত্র আবরী প্রচলিত ছিল—ইরানের রাষ্ট্রভাষা ছিল আরবী। তখনকার দিনে যেটুকু ফরাসী প্রচলিত ছিল সে ছিল ‘কাফির’, অগ্নিউপাসক, জরথুস্ত্রীদের ভাষা। সে ভাষায় একেশ্বরবাদের নামগন্ধ তো ছিলই না, তাতে ছিল দ্বৈতবাদের প্রচার, এককথায় সে ভাষা ছিল ন’সিকে ইসলাম-বিরোধী, ‘কাফিরী’। তবু কেন সে ভাষা চর্চা করা হল, এবং সে চর্চা করলেন কারা? কাফিরী জরথুস্ত্রীরা করে নি, করেছিলেন আরবীজাননেওয়ালা মুসলমানেরাই। কেন?

তুর্কীতেও তাই। কেন?

এ দুটো খাঁটি ইসলামি দেশের উদাহরণ; এবার স্বদেশে সেই দৃষ্টান্তই খোঁজা যাক্। পাঠান-মোগল যুগে এ দেশে ফার্সী ব-হাল তবিয়তে রাষ্ট্রভাষার রাজ সিংহাসনে বসে দিশী ভাষাগুলোর উপর রাজত্ব করত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সেই ফার্সীর সঙ্গে দেশজ হিন্দী মিলিয়ে উর্দু ভাষা কেন নির্মাণ করা হল ? কিন্তু সেটা আসল প্রশ্ন নয়, আসল প্রশ্ন যে-হিন্দীকে নিয়ে উর্দু বানানো হল সে ভাষা কি ‘পাক’ ছিল ?

আমরা জানি সে ভাষায় তখন তুলসীদাসের রামায়ণ সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক—এখনো তাই। সেই পুস্তকের আওতায় সমস্ত হিন্দী সাহিত্য গড়ে উঠেছে এবং তাতে আছে ইসলামদ্রোহী কট্টর মতবাদ। বাল্মীকির রামায়ণে যে ব্যক্তি মানুষ, রাজা এবং বীর, তিনি তুলসীর রামায়ণে খুদ ভগবানের আসন তসরূপ করে বসে আছেন ইসলামে মানুষকে আল্লার আসনে তোলা সবচেয়ে মারাত্মক কুফ্র্।

আজকের বাংলা ভাষা সেদিনকার হিন্দীর তুলনায় বহুগুণে পাক। আজ বাংলা সাহিত্যে যে ঈশ্বর গানে কবিতায় নন্দিত হচ্ছেন তিনি সুফীর মরমের আল্লা, হক্। তাঁর সন্ধান ‘গীতাঞ্জলিতে’- সে পুস্তক তামাম পৃথিবীতে সম্মান লাভ করেছে।

এবার যে দৃষ্টান্ত পেশ করব সেটি সভয়ে এবং ঈষৎ অনিচ্ছায়। দৃষ্টান্তটি কুরানের ভাষা নিয়ে এবং এ জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করার হক্ আলিম ফাজিলদের। কিন্তু শ্রদ্ধেয় গোলাম মোস্তফা সাহেব যখন রসূলুল্লার জীবনী থেকে নজির তুলে পূর্ববঙ্গবাসী মুসলমানকে ‘পাঞ্জাবী প্রভুত্ব’ বরদাস্ত করতে উপদেশ দিয়েছিলেন, (‘মক্কা হইতে মোহাজেরগণ যখন দলে দলে মদিনায় পৌছিতে লাগিলেন, তখন মদিনার আনসারগণ মক্কাবাসীদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতেন) আজ তাহারা—পাঞ্জাবীরা—আমাদের দুয়ারে অতিথি। আমাদের কি উচিত নয় তাহাদের প্রতি একটু (!) সহানুভূতি দেখানো ?’ ― (বিস্ময়বোধক চিহ্ন আমার) তখন আমিই বা এমনকি দোষ করলুম?

আরবী ভাষায় কুরানশরীফ যখন অবতীর্ণ হলেন তখন সে ভাষার কি রূপ ছিল? সে-ভাষা কি ‘পাক’ পবিত্র ছিল, না পৌত্তলিকতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল? আমরা জানি লাত, উজ্জা, মনাত প্রভৃতি দেব-দেবীর প্রশস্তিতে সে ভাষা পরিপূর্ণ ছিল এবং একেশ্বরবাদ বা অন্য কোনো সত্যধর্মের (খ্রীষ্ট অথবা ইহুদি) কণা মাত্র ঐতিহ্য সে ভাষায় ছিল না।

পক্ষান্তরে আরব দেশে বিস্তর ইহুদি ও খৃষ্টান ছিলেন। (হজরতের বহুপূর্বেই হিব্রুভাষা তওরিত ‘তোরা’ ও ওল্ড টেস্টামেন্ট’) বুকে ধরে পবিত্র ভাষারূপে গণ্য হয়েছিল, এবং হিব্রুর উপভাষা আমারমেইকের মাধ্যমে মহাপুরুষ ইসা ইঞ্জিল (এভানজেলিয়াম’ অথবা বাইবেলের ‘নিউ টেস্টামেন্ট’) প্রচার করেছিলেন। কুরান অবতীর্ণ হবার প্রাক্কালে হিব্রুভাষা একেশ্বরবাদ, মৃত্যুর পরের বিচার এর ফলস্বরূপ স্বর্গ অথবা নরক ইত্যাদি ইসলামের মূল বিশ্বাস (নবুওত ব্যতীত) প্রচারের ফলে হিব্রু ভাষা সেমিতি ধর্মজগতে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল।

তবু কেন সে ভাষার অবতীর্ণ না হয়ে কুরান শরীফ পৌত্তলিকের ভাষায় নাজিল হলেন।

এ পরম বিস্ময়ের বস্তু এবং শুধু আমরাই যে আজ বিস্মিত হচ্ছি তা নয়, স্বয়ং মহাপুরুষের আমলেও এ বিস্ময় বহুমুখে সপ্রকাশ হয়েছিল।

কিন্তু সে বিস্ময়ের সমাধান স্বয়ং আল্লাতাল্লা কুরান শরীফে করে দিয়েছেন। পাছে বাংলা অনুবাদে কোনো ভুল হয়ে যায় তাই মৌলানা আব্দুলা য়ুসুফ আলীর কুরান-অনুবাদ থেকে শব্দে শব্দে তুলে দিচ্ছি। আল্লা বলেন,

“Had we sent this as
A Quran (in a language)
Other than Arabic, they would
Have said: ‘Why are not
It’s verses explained in detail ?
What ! (a Book) not in
Arabic And (a Messenger) an Arab?”

অর্থাৎ “আমরা যদি আরবী ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় কুরান পাঠাতুম তা হলে তারা বলত এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হল না কেন? সে কি! (বই) আরবীতে নয় অথচ (পয়গম্বর) আরব”!

খুদাতালা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, আরব পয়গম্বর সে আরবী ভাষায় কুরান অবতরণের আধার হবেন সেই তো স্বাভাবিক, এবং অন্য যে-কোনো ভাষায় সে কুরান পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, ‘আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছি নে।’

কুরানের এই অঙ্গুলীনির্দেশ মত চললেই বুঝতে পারব ভাষার কৌলীন্য অকৌলীন্য অত্যন্ত অবান্তর প্রশ্ন, আসল উদ্দেশ্য ধর্মপুস্তক যেন আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারে। বারবার কতবার কুরানে বলা হয়েছে, ‘এ-বই খোলা বই’, ‘এ-বই আরবীতে অবতীর্ণ হল’ যাতে করে সর্বসাধারণের জন্য এ-বই সরল দিগ্‌দর্শক হতে পারে।

‘সর্বসাধারণ সনাতন ধর্মের বাণী মাতৃভাষায় বুঝুক’ এই মাহাত্ম্য যে কত গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বব্যঞ্জক সেকথা আমরা এখনো সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারি নি।

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পূর্বাচার্যগণ এ বাণী হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধর্মজ্ঞান যদি মুষ্টিমেয় পণ্ডিতের বিদ্যাচর্চার বিলাসবস্তু না হয়ে আপামর জনসাধারণের নিত্য অবলম্বনীয় সখারূপে সপ্রকাশ হ’তে চায় তবে সে ধর্মশিক্ষা মাতৃভাষাতেই দিতে হবে। কোনো বিদেশী ভাষা দ্বারা জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব, মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হবে, তা সে-মাতৃভাষা পূতপবিত্রই হোক্ আর ওছা নাপাকই হোক। এ তত্ত্বটা ইরানের মনীষীরা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই একদা ইরানে আরবীয় বহুল প্রচার থাকা সত্ত্বেও ‘নাপাক’ ফার্সী ভাষাকে ধর্মশিক্ষার বাহনরূপে ব্যবহার করেছিলেন। ভারতীয় মনীষীরা ঠিক সেই কারণেই এদেশে বিদেশী ফার্সী প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও ‘না-পাক’ হিন্দীর সঙ্গে আরবী ফার্সী মিলিয়ে উর্দু নির্মাণ করেছিলেন।

বাংলাদেশের মৌলবী-মাওলানারা সস্তায় কিস্তিমাত করতে চেয়েছিলেন বলেই দেশজ বাংলাকে ধর্মশিক্ষার বাহন রূপে স্বীকার করেন নি—উর্দু দিয়ে ফাঁকতালে কাজ সারিয়ে নেবার চেষ্টাতেই ছিলেন। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে আজ এই খেসারত দিতে হচ্ছে যে, ‘নিজ বাসভূমে, পরবাসী হওয়ার’ মত নিজ মাতৃভাষায় যে-কোনো কিছুরই চর্চা করতে পারে নি। যুক্তপ্রদেশে তথা পাঞ্জাবের মৌলবী-মওলানাগণ যে রকম মাতৃভাষা উর্দুর সাহায্যে শাস্ত্রচর্চা করেছিলেন, বাঙালী আলিমগণও যদি বাংলায় সে-রকম শাস্ত্রচর্চা করে রাখতেন তা হলে সেই সূত্রপাতের খেই ধরে আজ বাঙালী মুসলমান নানা সাহিত্য নির্মাণ করে অনেক দুর এগিয়ে যেতে পারত। এবং যখন দেখি, যে-বাঙালী আলিমগণ বাংলায় শাস্ত্রচর্চা না করে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে অজ্ঞ রাখলেন তাঁরাই বাঙালী তরুণকে তার ধর্মশাস্ত্রের অজ্ঞতা নিয়ে তাচ্ছিল্য অবহেলা করেন তখন বিস্ময়ে বাক্যস্ফুরণ হয় না। আপন কর্তব্যচতি ঢাকবার এই কি সরলতম পন্থা ? এবং, তাঁরা একথাটাও বুঝলেন না যে, বাঙালী হিন্দু যে রকম সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে শাস্ত্রগ্রন্থ বাংলাতে অনুবাদ ও প্রচার করার জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়, তাঁরাও বাংলায় ইসলামী শাস্ত্রের চর্চা করলে বাঙালী মুসলমানের কাছ থেকে সে রকম শ্রদ্ধাঞ্জলি পেতেন।

আবার বলি, এখনো সময় আছে। উর্দু-বাংলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাঁরা সরল বাংলা (লিসানু-ম্মুবীন) গ্রহণ করবেন, না আবার উর্দু দিয়ে ফোকটে কাজ সারবার তালে থাকবেন?

ধর্মজগতে পোপকে একদা এই দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁর খাস পেয়ারা লাতিন সর্বদেশের সর্বমাতৃভাষাকে পদদলিত করে—

পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে দুঃখীর বুক জুড়ি,
ভগবানের ব্যথার ‘পরে হাঁকায় সে চার-ঘুড়ী

—করবে, না তিনি লুথারের প্রস্তাবমত মাতৃভাষায় শাস্ত্রচর্চা করতে দেবেন? পোপ সত্যপথ দেখতে পান নি, তিনি ভুল করেছিলেন। ফলে খ্রীষ্টজগৎ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।

আজ যদি জোর করে পোপের ভ্রান্তাদর্শ অনুসরণ করে উর্দুওয়ালা পূর্ব পাকিস্তানের স্কন্ধে উর্দু চাপান তবে লুথারের মত লোক পূর্ব পাকিস্তানে খাড়া হতে পারে। যাঁরা অখণ্ড পাকিস্তান চান তাঁরা এই কথাটি ভেবে দেখবেন।

ভাষার ‘পাকী’ ‘না-পাকী’ সম্বন্ধে আমার শেষ দ্বিধাটি এইবার নিবেদন করি আমার যে এত তর্কাতর্কি করছি, কিন্তু নিজের মনকে কি একবারও জিজ্ঞেস করেছি ‘পাকিস্তান’ শব্দটির জন্ম কোথায়, সে জাতে ‘পাক’, ‘না ‘নাপাক’? ‘পাক’ কথাটা তো আরবী নয়, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ‘প’ (অথবা ‘পে’) অক্ষরটি আরবী নয়, ‘প’ অক্ষরটি ফার্সী অর্থাৎ প্রাচীন ইরানী অর্থাৎ অগ্নি-উপাসক কাফিরদের শব্দ, এবং এই জেন্দা-আবেস্তার শব্দটির সঙ্গে যুক্ত আছে সংস্কৃত ‘পক্ক শব্দ (‘পাক্ শব্দটি সংস্কৃত নয়, কিন্তু আবেস্তা ও সংস্কৃত যমজ-ভাষা) এবং ‘স্তান কথাটি যে সংস্কৃত স্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সে কথাও সকলেই জানেন। দুটি শব্দই আরবী নয়, প্রাচীন ইরানী, এবং প্রাচীন ইরানী বাংলা অপেক্ষা কোনো দিক দিয়ে ‘পাক’ নয় । ভাষার দিক দিয়ে যদি সত্যই সম্পূর্ণ “পাক্‌” নাম দিতে হয় তবে তো পাকিস্তানকে ‘বয়তুল মুদ্দাসের’ ওজনে ‘মুমলকতুল মুকদ্দস’ জাতীয় কোনো নাম দিতে হয়।

তাই বলি ‘পাক’ ‘না-পাকের’ প্রশ্ন শুধানো ইসলাম-ঐতিহ্য পরিপন্থী।

কোনো মানুষকে না-পাক বলে যেমন তাকে কলমা থেকে বঞ্চিত করা যায়। না, কোনো ভাষাকে ঠিক তেমনি ‘না-পাক’ নাম দিয়ে ইসলামি শিক্ষা-ঐতিহ্যর বাহক হওয়া থেকে বঞ্চিত করা যায় না। ‘ছুৎ বাই’ ইসলামি মার্গ নয়।

কেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন, কেন্দ্রের চাকরি, কেন্দ্রীয় পরিষদে বক্তৃতাদান ইত্যাদি বিষয়ে বাংলা কতদূর প্রতিবন্ধক হবে-না-হবে সে বিষয়ে আলোচনা অন্য প্রসঙ্গে প্রবন্ধের গোড়ার দিকে করা হয়ে গিয়েছে। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা সম্বন্ধে আর যেসব ছোটখাটো আপত্তি আছে তার অন্যতম ব্যবসাবাণিজ্য।

উর্দুওয়ালারা বলেন, “ইংরেজি তাড়িয়ে দিলুম, উর্দু শিখলুম না, তা হলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করব কি করে?”

এর উত্তর এতই সরল যে দেওয়াটা বোধ হয় নিষ্প্রযোজন। ইংলণ্ডের শতকরা ৯৯ জন ফরাসী জানে না, ফ্রান্সের ৯৯৯ ইংরেজি জানে না, তৎসত্ত্বেও ব্যবসা চলে। তার চেয়েও সরল উদাহরণ আছে। মারোয়াড়ীরা প্রায় এক শ’ বৎসর ধরে বাংলাদেশ শুষে খাচ্ছে, আমাদের কফনের কাপড় বিক্রি করে তারা মারোয়াড়ে তিনতলা বাড়ী বানায় কিন্তু সমস্ত মারোয়াড় দেশে বাংলা পড়বার জন্য একটা স্কুল নেই, কোনোকালে ছিলও না। এসব তো হল খুচরা ব্যবসায়ের কথা। প্রদেশে প্রদেশে, দেশে দেশে ব্যবসায়ের যোগাযোগ হয় বড় বড় কারবারীদের মধ্যস্থতায় । দমস্কসে যে জর্মন ভদ্রলোক সীমেন শুকার্টের কলকবজা বিক্রয় করতেন তিনি তড়বড় করে আরবী বলতে পারতেন—তাই বলে গোটা জার্মানীর পাঠশালা স্কুলে তো আরবী পড়ানো হয় না।

পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যে বড় বড় ব্যবসা হবে, সে হবে করাচীর সঙ্গে। করাচীর ভাষা সিন্ধী—কারবারী মহলে চলে ইংরেজী, সিন্ধী এবং কিঞ্চিৎ গুজরাতী। ব্যবসায়ের জন্য ভাষা শিখতে হলে তো আমাদের সিন্ধী শিখতে হয়।

ব্যবসা যে করে ভাষার মাথা-ব্যথা তার। শিক্ষা বিভাগ এবং দেশের দায়িত্ব এইটুকু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগে তার জন্য সামান্যতম বন্দোবস্ত করে দেওয়া। সেটুকু কেন তার চেয়ে ঢের বেশী উর্দু আমরা পূর্ব পাকিস্তানে শেখাব। সে-কথা পরে হবে।

এ জাতীয় খুঁটিনাটি আরো অনেক সমস্যা আছে কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্যে কখনই পৌঁছানো যাবে না।

উর্দু-বাংলা দ্বন্দ্বের শেষ সমাধান করতে হলে বিচার-বিবেচনা আবশ্যক যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ কি?—আশা করি একথা কেউ বলবেন না যে একমাত্র উর্দুর সেবা করার জন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের আদর্শ কি সে সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত মত দেবার কোনো অর্থ হয় না। নানা গুণী যে নানা মত দিতেছেন তার মাঝখানে একটি সত্য কথা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন…সে হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানকে সর্বপ্রথম সমৃদ্ধবান রাষ্ট্র করতে হবে।

তা হলেই প্রশ্ন উঠবে সমৃদ্ধশালী হতে হলে যে শক্তির প্রয়োজন সে শক্তি সুপ্তাবস্থায় আছে কোনখানে?

পাকিস্তান তথা ভারত ইউনিয়নের স্বাধীনতা যে সফল হল তার প্রধান কারণ গণ-আন্দোলন। যত দিন কংগ্রেস বলতে ‘স্টেটসমেনের’ ভাষায় ‘ভড্রলোক ক্লাস’, যত দিন লীগ বলতে রামপুর ভূপাল খানবাহাদুর, খানসায়েবেদের বোঝাত ততদিন ইংরেজ ‘স্বরাজ’ এবং ‘পাকিস্তানের’ থোড়াই পরোয়া করেছে। কিন্তু যেদিন দেখা গেল যে লীগের পশ্চাতে জনসাধারণ এসে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ লীগ আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছে সেদিন আর পাকিস্তানের দাবী কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনসাধারণের শক্তি প্রয়োগে।

জনসাধারণের সেই শক্তি সেদিন বিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল। আজ সে শক্তি সুষুপ্ত, এবং সেই শক্তি যদি পাকিস্তান গঠনে নিয়োজিত না হয় তবে পাকিস্তান কখনই পূর্ণাবয়ব, প্রাণবন্ত রাষ্ট্ররূপে দুনিয়ার মজলিসে আসন নিতে পারবে না। মার্কস্বাদের মূল সিদ্ধান্ত ঠিক কিনা সে আলোচনা এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর, ইসলামের সঙ্গে যাঁদের সামান্যতম পরিচয় আছে তাঁরাই জানেন, ইসলাম কোনো বিশেষ বর্ণ, জাতি বা শ্রেণীকে শ্রেষ্ঠত্বের আশীর্বাদ দিয়ে অজরামর করে তুলতে সম্পূর্ণ নারাজ।

যাঁরা ধর্মকে—তা সে ইসলামই হোক্ আর হিন্দু ধর্মই হোক্—রাজনীতি থেকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে চান তাঁদের উদ্দেশে আমার এস্থানে দু-একটি বক্তব্য আছে। ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ধর্ম যে এ দুনিয়ায় এখনো প্রচণ্ড শক্তির আধার সেকথা অস্বীকার করলে আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতি পদে অপ্রত্যাশিত সঙ্কটের সম্মুখে উপস্থিত হব। এই যে আমারা বারবার শুনতে পাই ইয়োরোপ নাস্তিক, ইয়োরোপীয় রাজনীতি ধর্মকে উপেক্ষা করে চলে সে-কথাটা কতদূর সত্য? ফ্রান্স জর্মনীতে এখনো ক্রীশ্চান পার্টিগুলো কতটা শক্তি ধারণ করে সে কথা সবচেয়ে বেশী জানেন কম্যুনিস্টরা। ক্রীশ্চান ডেমোক্রেট, ক্যাথলিক সেন্টার এদের অবহেলা করে কোনো ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন চালানো এখনো ফ্রান্স, জর্মনী, ইতালিতে অসম্ভব। এই তো সেদিন রাজনীতিক্ষেত্রে এখনো পোপের কত ক্ষমতা সেটা ধরে পড়ল ইতালির গণভোটে। পোপ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ যেদিন সশরীরে। কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে আসরে নামলেন সেদিন কমরেড তল্লাত্তি প্রমাদ গুণলেন। । শেষ রক্ষার জন্য ধর্মহীন তল্লাত্তিকে পর্যন্ত বলতে হল ভবিষ্যৎ ইতালিয় কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি, বিষয়-আশয়ে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না, এযাবৎ তারা যেসব সুখ-সুবিধা উপভোগ করে আসছেন তার সব কটাই তাঁরা নিশ্চিন্ত মনে উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু এ শ্মশান-চিকিৎসায়ও ফল হল না, তল্লাত্তির নির্মম পরাজয়ের কথা সকলেই জানেন। পোপ এই ভোট-মারে নেবে ভালো করেছিলেন কি মন্দ করেছিলেন সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর, আমাদের শুধু এইটুকুই দেখানো উদ্দেশ্য যে ধর্ম এখনো বহু শক্তি ধারণ করে।

মৃত্যুর পর বেহেশৎ বা মোক্ষ দান করাই ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বিশেষত ইসলাম সংসারের সর্বস্ব ত্যাগ করে, গুহা-গহ্বরে বসে নাসিকাগ্রে মনোনিবেশ করার ঘোরতর বিরুদ্ধ মতবাদ প্রচার করে। আল্লাতা’লা, কুরানশরীফে বারংবার বলেছেন যে এই সংসারে তিনি নানারকম জিনিস মানুষকে দিয়েছেন তার আনন্দ বর্ধনের জন্য। তাই মুসলিম মাত্রই প্রার্থনা করে, ‘হে আমাদের প্রভু, ইহলোকে আমাদের শুভ হোক, পরলোকে আমাদের শুভ হোক।’ এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইহলোকের মঙ্গল অতীব কাম্য, তাই প্রশ্ন ওঠে পার্থিব বস্তু কোন্ পদ্ধতিতে উপভোগ করব যাতে করে অমঙ্গল না হয়?

তাই বিশেষ করে ইসলামই পার্থিব বস্তুর ভাগবাটোয়ারা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন । কুরানশরীফ বারংবার ধনবণ্টন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন, এবং সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত দেন।

মহাপুরুষ মুহম্মদের (দ.) সঙ্গে মক্কাবাসীদের দ্বন্দ্ব হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ পার্থিব বস্তুর নবীন বণ্টনপদ্ধতি নিয়ে। ‘সাইল’ অর্থ ভিখারী নয়, ‘সাইল’ বলতে আজকাল আমরা ইংরেজীতে ‘হ্যাভ নট’ বাক্যে যা বুঝি তাই। ‘সাইলকে বিমুখ করো না’ এই আদেশ মক্কার ধনপতিগণ গ্রহণ করতে কিছুতেই সম্মত হয় নি, অথচ এই নবীন পদ্ধতি দুঃস্থ নিপীড়িত বিত্তহীনদের প্রাণে নতুন আশার বাণী এনে দিয়েছিল । ফলে দেখতে পাই মহাপুরুষের প্রথম শিষ্যদের ভেতর বিত্তহীন ও দাসের সংখ্যা বেশী।

ইহকাল পরকালের মঙ্গল আদর্শ নিয়ে এই যে আন্দোলন সৃষ্ট হল তার বিজয় অভিযান পৃথিবীর ইতিহাসে আপন স্থান করে নিয়েছে— কিন্তু সে ইতিহাস আলোচনা করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এইটুকু দেখতে চাই, মহাপুরুষের চতুর্দিকে যে বিরাট আন্দোলন ক্রমে ক্রমে জাগ্রত হল সে আন্দোলন গণ-আন্দোলন। মহাপুরুষ যে নবীন আন্দোলন সফল করে তুললেন সে এই জনগণের সাহায্যে।

আজ পাকিস্তান যে বিরাট আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে আন্দোলন জনগণ দিয়েই গঠিত হবে। এ আন্দোলনে থাকবে নূতন ধনবণ্টন পদ্ধতি, নূতন ধনার্জন পন্থা, শিক্ষার প্রসার, গণতান্ত্রিক নির্বাচন-পন্থা, স্বাস্থ্যের উন্নতি, সংস্কৃতি বৈদ্য নির্মাণপ্রচেষ্টা, — এককথায় প্রাচীন শোষণনীতি সমূলে উৎপাটন করে সাম্য মৈত্রী-স্বাধীনতার সর্বাঙ্গীণ সম্পূর্ণ বিকাশ।

কিন্তু যদি জনগণ এ আন্দোলনে অংশীদার না হয় তবে সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থ হবে। জনসাধারণ যদি আন্দোলনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে এবং না বুঝতে পেরে আপন প্রচেষ্টা নিয়োগ করতে কুণ্ঠিত হয়, অথবা প্রয়োজনমত স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত না হয় কিংবা ধনপতিদের উৎকোচে বশীভূত হয়, অথবা দু’চার আনা মজুরী বৃদ্ধিতেই যদি বৃহত্তর স্বার্থকে ত্যাগ করে তবে সম্পূর্ণ আন্দোলন নিষ্ফল হবে।

এবং এস্থলে আমার কন্ঠে যত শক্তি আছে তাই দিয়ে আমি চিৎকার করে বলতে চাই, মাতৃভাষা বাংলার সাহায্য বিনা জনসাধারণকে এই বিরাট আন্দোলনের বিস্তৃত শাখাপ্রশাখা সম্বন্ধে সচেতন এবং ওয়াকিবহাল করা যাবে না, যাবে না, যাবে না, যাবে না।

উর্দুওয়ালারা বলবেন,—উচ্চশিক্ষা উর্দুর মাধ্যমিকে দেব বটে কিন্তু শিক্ষিতেরা কেতাব লিখবেন বাংলায়।

আমার বক্তব্য,—ঠিক ঐ জিনিসটেই হয় না, কখনো হয় নি। দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখাই, ইংরেজ আমাদিগকে কখনো ইংরেজী বই লিখতে বাধ্য করে নি, তবুও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে গত একশত বৎসর ধরে যত উত্তম উত্তম ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতন্ত্র, দর্শন সম্বন্ধে বই বেরিয়েছে তার শতকরা ৯৫ খানা ইংরেজীতে কেন ? জ্ঞানচর্চা করব একভাষায় আর তার ফল প্রকাশ করব অন্য ভাষায়, এই বন্ধ্যা-প্রসব কখনো কস্মিনকালেও হয় না। মানুষ যখন আপন মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয় চিন্তা করতে শেখে তখনই সে মাতৃভাষায় লিখতে শেখে।

অর্থাৎ ইংরেজী আমলে যা হয়েছিল তারি পুনরাবৃত্তি হবে। একদল উর্দুশিক্ষিত লোক উর্দুতে লেখাপড়া শিখবেন, বড় নোকরি করবেন, বহিরাগত উর্দুভাষীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে এক নূতন অভিজাত সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, আর বাদবাকি আমরা চাষাভুষো পাঁচজন যে তিমিরে ছিলুম সেই তিমিরেই থাকব।

তাই পুনরায় স্মরণ করিয়ে দি, হজরতের চতুর্দিকে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল, এবং পরে যে রাষ্ট্র-সংগঠন অভিযান আরম্ভ হয়েছিল তার মাধ্যমিক ছিল আপামর জনসাধারণের ভাষা,—আরবী। বিদগ্ধ হিব্রুকে তখন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল।

উর্দুওয়ালারা বলবেন—বাংলা জানলেই কি সব বাংলা বই পড়া যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বাংলা চালাই, এবং ফলে যদি সকল রকমের বই-ই বাংলাতে লেখা হয় তা হলেই কি আপমর জনসাধারণ সেসব বই পড়তে পারবে?

উত্তরে বলি, সকলে পারবে না, কিন্তু অসংখ্য লোক পারবে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →