বারীন বাবু বলেছেন কোলকাতা থেকেই সব করে দেয়া যাবে (১৯৭২) Featured

আবদুল হামিদ খান ভাসনাীর ‘সাপ্তাহিক হক-কথা’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ, ২২ তম সংখ্যায় (শুক্রবার, ১১ই শ্রাবণ ১৩৭৯, ২৮শে জুলাই, ১৯৭২) এই রিপোর্ট’টা ছাপা হইছিল।
রির্পোট’টাতে অভিযোগ করা হইছে যে, কয়েকজন এমপি ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার পর পর সরকারি টেক্সট বুক ছাপানোর কাজ ইন্ডিয়াতে দিয়া দিতে চাইতেছেন; পরে কি ডিসিশান হইছিল, সেইটা আর জানা যায় নাই, কারণ এর কয়দিন পরেই ‘হক-কথা’ পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন বাতিল কইরা সার্কুলেশন বন্ধ কইরা দেয় অই সময়ের গর্ভমেন্ট। তবে খোঁজ-খবর নিলে জানা তো যাইতেই পারে – কি হইছিলো শেষে, আগুন লাইগা সরকারি নথি-পত্র যদি পুইড়া না যায় বা কোনভাবে যদি মিসিং না হয়া যায়।…
তো, এই ইয়াং এমপি’রা (এখন হয়তো বুড়া হইছেন বা মারা গেছেন) দেশের ব্যবসায়ীদের কাজ না দিয়া কলকাতার প্রেসগুলাতে কাজ কেন দিতে চাইতেছিলেন? উনারা ‘ইন্ডিয়ার দালাল’ এবং মানুশ হিসাবে ‘খারাপ’ বইলা?… জিনিস’টারে এতোটা ‘সরলভাবে’ দেখাটা মনেহয় ঠিক হবে না। পলিটিক্যালি এইরকমভাবে তো দেখা যাইতেই পারে, কিন্তু এইরকম’টা কেন ঘটছিলো (বা এখনো ঘটতেছে), সেইটা মেবি পলিটিক্স জিনিসটারে আমরা যেইভাবে দেখি, সেইটারই একটা রেজাল্ট।
মানে, লোকজন পলিটিকস কেন করে? দেশ ও দশের ‘সেবা’ করার লাইগা? 🙂 সেইটা তো আছেই, তার বাইরেও ক্ষমতা তো একটা ঘটনা; কিন্তু আপনার যদি টাকা-পয়সা না থাকে, ক্ষমতা দিয়া কি করবেন; মানে, ‘ক্ষমতায় থাকার’ একটা মানে হইতেছে টাকা-পয়সা কামাই করা। যদি টাকা-পয়সাই না বানাইতে পারলেন, তাইলে পলিটিকস কইরা আপনি কি করলেন! (এই ধরণের পলিটিশিয়ানদের আমরা ‘ভালো’ না বইলা বেকুব-ই বলবো এখন, যে কিনা নিজের ভালো’টাও বুৃঝে না!) এখন অবশ্য উল্টাটাও হয়, অনেক টাকা-পয়সাঅলা লোকেরাও পলিটিকসে ‘নামেন’, কারণ ক্ষমতার রুলস-রেগুলেশন ছাড়া টাকা-পয়সা সিকিওর করা বা বাড়ানো সম্ভব না।…
তো, অই সময়ের প্রেস-মালিক ও প্রিন্টিং ব্যবসায়ী’রা ভাবছেন দেশ যেহেতু স্বাধীন, আমরা পলিটিশিয়ানদেরকে টাকা-পয়সা কেন দিবো! অরা তো আমাদের লোক! কিন্তু পলিটিশিয়ানদেরও তো টাকা দরকার, আর খেয়াল কইরা দেখবেন যারা ঘুষ খায় পরিচিত লোকজনদের কাছ থিকা খাইতে চায় না, কারণ কে সাইধা পইড়া ‘খারাপ লোক’ হবে, একটা আড়াল থাকলে তো বেটার। এই কারণে দেশি ব্যবসায়ীদের চাইতে বিদেশি ব্যবসায়ী’রা পলিটিশিয়ানদের কাছে সবসময়ই প্রেফারেবল হওয়ার কথা। আমি শিওর, ঢাকার প্রেস-মালিক ও পুস্তক ব্যবসায়ী’রা তাদের এই ‘ভুল’ পরে বুঝতে পারছেন এবং তাদের বিজনেস ধইরা রাখতে পারতেছেন।
২.
নিউজপেপারের বাইরে, প্রেস, প্রিন্টিং এবং পুস্তক-ব্যবসা মেইনলি সরকারি বই ছাপানো ও কেনার উপরেই ডিপেন্ডেড, এমনকি বইমেলায় ছাপানো বইও সরকারি নানান লাইব্রেরি’র নামে কিনে বইলাই ছাপানো যায় বেশিরভাগ সময়। (সেবা প্রকাশনী, হুমায়ূন আহমেদ ও ‘ইসলামী বইয়ের’ কিছু মার্কেট আছে…) এখন অবশ্য প্রাইভেট কোম্পানি ও এনজিওদের ছাপাছাপি বাড়ছে; কিন্তু বই এবং প্রিন্টিং ইন্ড্রাষ্ট্রি’টার বড় অংশের কাজ গর্ভমেন্টেরই।… মানে, ‘বই ছাপানো’ ও ‘জ্ঞান’ জিনিসটাও যে একটা উৎপাদন ও ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের ঘটনা, এইটা মাথায় রাখতে পারলে মনেহয় ভালো।…
তো, আমাদের এইখানে বাংলা একাডেমি’র বইমেলা হইতেছে পাবলিশারদের বুক ডিস্ট্রিবিউশনের একটা অল্টারনেটিভ সিস্টেম, যেইখানে প.বাংলা’র পাবলিশারদের একসেস না দেয়ার আন্দোলন করছিলেন আহমদ ছফা; ব্যবসার দিক দিয়া চিন্তা করলে ভালো জিনিস ছিল সেইটা; যে, ইন্ডিয়া যেহেতু বাংলাদেশের বই এবং কালচারাল ম্যাটেরিয়ালগুলা ইন্ডিয়াতে এক রকমের রেস্ট্রিক্ট কইরা রাখছে, আমাদেরকেও সেইটা করতে পারা দরকার; কিন্তু এইটা কোনভাবেই পাওয়ারের জায়গাটারে পুরাপুরি স্পষ্ট করতে পারে না, ডমিনেন্সটা এইখানে খালি বাজার দখলের না, বরং কালচারাল হিস্ট্রিটারে কলোনিয়াল লিগাসির জায়গা থিকা রিড করার যেই তরিকাটা চালু আছে, সেইখানে অনেক বেশি।…
৩.
আর এই জায়গা থিকা, কলকাতা মানে যে ইন্ডিয়া, এইটা মনেহয় আমরা অনেকেই নিজেদেরকে মানাইতে পারি না। কিন্তু বাংলাদেশে দিল্লী’র দালালি করার ভিতর দিয়াই কলকাতা যে পলিটিক্যালি নিজেদেরকে এখনো রিলিভেন্ট রাখতে পারে, এইটারে বাস্তবতা হিসাবে না মানলেই নাই হয়া যায় না আর কি!
ই. হা.
………………………
চারজন এমসিএ বাংলাদেশের সম্ভবনাময় ও প্রতিশ্রুতিশীল প্রকাশনা শিল্প ও এর সাথে জড়িত সাথে একুশে লাখ লোককে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ভারতে অবস্থানকালে সাত লাখ টাকা পণ দিয়ে হিন্দু কুমারীকে বিয়ে করার জন্য কেলেঙ্কারী যে এমসিএটি ঘটিয়েছে, যে কলমজীবী ফতুর এমসিএটি ৫৫ হাজার টাকা দামের কার্ডিলা গাৰ্জী উপহার পেয়েছে, তাদের কাঁধে সওয়ার হয় ভারতের প্রকাশকচক্র এবং খোদ ভারতীয় সরকারী মহল বাংলাদেশকে শোষণের আরেকটি উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প ও পাঠ্যপুস্তকের বাজার দখলের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ভারত যাকে যেমনভাবে পেরেছে, কোন বুদ্ধকে তরুণী ভার্যা দিয়ে, ফোন উচ্চাভিলাসীকে কার্ডিলাক গাড়ি দিয়ে, কোন অপদার্থকে মন্ত্রী বানাবার আশ্বাস দিয়ে, কোন বহিরাগতকে বাংলাদেশের খোদ কর্তার প্রিয়পাত্রে পরিণত করার আশ্বাস দিয়ে প্রকাশনা সেক্টরে পঞ্চম বাহিনী সৃষ্টি করেছে। আজ এই কেনা গোলামেরা ভারতের ইঙ্গিতে এক বিরাট পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পকে পঙ্গু করে ভারতের হাতে তার দায়িত্ব তুলে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর পরই ভারত থেকে এসে, শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তনের আগেই এরা দারুণ হৈচৈ করে এমন একটা ভাব সৃষ্টি করে যে, প্রকাশনা ও পুস্তক ব্যবসায়ে তাদের চাইতে বিশেষজ্ঞ আর কেউ নেই। তারাই সব ম্যানেজ করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে প্রভুর কাছে দিয়ে আসা অঙ্গীকার পূরণের পথে না জানি কোন ব্যাঘাত হয়, এই ভেবেই তারা প্রকাশনা শিল্পের দিকটির পথ আগলে দাঁড়ায়।
শিক্ষা দফতর, শিক্ষা সম্প্রসারণ বিভাগ থাকা সত্বেও পুস্তক প্রকাশনা শিল্পকে মানুষ করার জন্য গবাদি মন্ত্রী নাজেল হবার গূঢ় রহস্য এখানেই।
ফলে টেক্সট বুক বোর্ড – পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চাবিকাঠি এদের হাতে এসে যাবার পরেই এরা আশ্বস্ত হয়ে ‘কাজ’ শুরু করে। বোর্ডের ঐ কর্মকর্তা, চাররত্ম ও দুজন প্রকাশক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত পাঠ্যপুস্তক প্যানেল স্বাধীনতার পর প্রথম বৈঠকে মিলিত হলে অত্যুৎসাহী একরত্নের মুখ থেকে আসল কথাটি ফাঁস হয়ে পড়ে। আমরা সব বই ছেপেছুপে নেবো বলে একরত্ন তম্বি শুরু করলে অভিজ্ঞ প্রকাশকরা যখন বলেন যে, এটা কি সম্ভব? দেশব্যাপী কাঠামো নিয়ে দণ্ডায়মান সমগ্র শিল্পটিই যখন বোর্ডের বই প্রকাশনা যথা সময়ে সম্পন্ন করতে হিমশিম খেয়ে যায়, তখন আপনারা হঠাৎ করে পারবেন কিভাবে। ঠিক এ পর্যায়ে ব্রাহ্মণ ঠাকুর ও ঢাকা এমসিএদ্বয় ‘উঠে আসুন’, ‘উঠে আসুন’ হাকডাক দিতে দিতে বলে ফেলেন যে, “কোলকাতায় বারী বাবুর সাথে সব কিছু আলোচনা হয়েছে। তিনি সব বই ছেপে সরবরাহ করতে রাজী। তাঁকে এক পার্সেন্ট দিলেও চলবে, না দিলেও চলবে।’
দেশে সম্ভাবনাময় ও স্বনির্ভর প্রকাশনা শিল্প বিদ্যমান থাকতে কতিপয় এমসিএ ভারতে বারী বাবুকে দিয়ে দেশের প্রধান পুস্তকগুলি মুদ্রণের ব্যবস্থা করবেন জেনে প্ৰকাশক ও বোর্ডের প্রতিনিধিরা ‘থ’ হয়ে যান।
এ বারীন বাবু সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভদ্রলোকটি ১৯৫৮ সালের পূর্বে টাকায় গ্রেটবেঙ্গল লাইব্রেরীর কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৫৮ সালের কিছুদিন পূর্বে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের পুস্তকের বাজার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তালাস করতে এসে ভারতের প্রকাশক চক্র বারীন বাবুকে ভারতে নিয়ে যান এবং নিজেদেনা উপদেষ্টা হিসাবে পৃথক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ তাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল ভারতের উর্বর পুস্তক বাজার। বারীন বাবু বিশিষ্ট রপ্তানীকারক হিসাবে তখনই এখান থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাটের কারবারে ভারতীয় প্রকাশক ও সরকারকে সাহায্য করে আসছিলেন।