Main menu

রাধারমণের গীত

“কালা কাজলের পাখি দেইখা আইলাম কই
জলে গিয়াছিলাম সই”

এই গানের মধ্য দিয়া বলা যায় রাধারমণরে আমার প্রথম চেনা। প্রাইমারি স্কুলের সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রোগ্রামে এইটা শুইনা শুইনা শিইখা গেছিলাম। খুবই পছন্দের গান হইয়া গেছিলো এইটা তখন। ধামাইল নাচও টুকটাক দেখছি আর নাচছি ছোটবেলায়। সেইখানেও তার গানগুলা গাওয়া হইতো। যদিও তখন জানা ছিলো না এইসব কার গান বা এইসব নিয়া ভাবাও হয় নাই তখন যে রাধারমণ কে।

তো রাধারমণরে নিয়া জানার শুরুটা বলা যায় ক্লাস নাইন টেনে উঠার পর। আস্তে আস্তে তার আরো গান জানলাম, শুনলাম, শিখলাম। তখন থাইকা তারে জানার আগ্রহ তৈরি হওয়া বলা যায়। কারণ তখন নিজের মধ্যে একটা গর্বের মতো ফিল হইতো যে রাধারমণ নিজের এলাকার মানুশ। মনে হইতো যে নিজের এলাকার একজন মানুশ যার গান দেশের কত মানুশ শুনতেছে, গাইতেছে বা তারে চিনতেছে। নরমালি আমাদের এলাকায় স্কুল-কলেজের প্রোগ্রামগুলায় তার গান বলা যায় সবসময় গাওয়া হইতো। যার কারণে সবাইই তার গান নিয়া মোটামুটি জানে। এরপর কলেজে যাওয়া হইলো তখন তারে নিয়া আগ্রহ আরো বাড়লো। কারণ আমাদের কলেজের পুরা জায়গাটার মালিক নাকি তিনি এইরকম শুনছি। অনেক বড় একটা জায়গা। আবার কলেজের পাশেই ছিলো তার বাড়ি বা এখন মনে হয় এইটারে রাধারমণ মন্দিরও বলা হইয়া থাকে। তো অনেকদিন যাইমু যাইমু বইলাও অবশেষে আর যাওয়া হয় নাই। তার বাড়ি দেখা হয় নাই। তো এইটা আমার এক সময় আফসোসের মতোই ছিলো।

রাধারমণ দত্ত পুরাকায়স্থ যারে রাধারমণ বইলাই আমরা জানি। তার জন্ম হইছিলো সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে। তিনি মূলত একজন গীতিকবি এর সাথে আরো কিছু যোগ করতে চাইলে বলা যায় মরমিকবি, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, ধামাইল গানের স্রষ্টা। রাধারমণের মধ্য দিয়া ধামাইল গান সবচেয়ে বেশি প্রচারিত ও প্রচলিত হওয়ায় তারেই এর স্রষ্টা বইলা মনে করা হয়। সিলেট অঞ্চলে মূলত গ্রামের দিকে বিয়া বা অনেক সময় অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠান উপলক্ষে একধরণের নাচ হয় যেইটারে বলা হয় ধামাইল। এই ধামাইলের জন্য আলাদা কিছু গান আছে। তো অইসব গান গাইয়া এই নাচটা নাচা হয়। সাধারণত যারা নাচেন তারা তালে তালে হাততালির মাধ্যমে চক্রাকারে ঘুইরা ঘুইরা একলগে এই গানগুলা গান। ধামাইলের গান রাধারমণ ছাড়াও আরো কেউ কেউও রচনা করছেন। তবে পঁচানব্বই শতাংশ গানই রাধারমণের গান। ধামাইল নাচ এখন অনেকটা হারাইয়া গেছে বলা যায়। আগের মতো সব জায়গায় আর এখন এইটা অত হয় না।

জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওড়ে রাধারমণ আশ্রম গইড়া তুলেন।সেইখানেই তার সাধন-ভজন চলতো। রাধারমণ কখনো তার গানগুলা নিজে লেইখা রাখেন নাই। তিনি মুখে মুখেই এইগুলা গাইছেন। পরিবর্তিতে তার ভক্তরা অইগুলা শুইনা লিপিবদ্ধ করছেন। যার কারণে অনেক গানের মধ্যেই ছোটখাটো পরিবর্তনও আসছে আর আসাটা স্বাভাবিক। আবার অনেক গানই হয়তো লিপিবদ্ধ হয় নাই। যার কারণে নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না তিনি কতগুলা গান রচনা করছেন। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন তথ্য আছে তার গানের সংখ্যা নিয়া।বলা যায় তিনি দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, বিরহ, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরনের কয়েক হাজার গান রচনা করছেন।

রাধারমণকে অনেকে বাউল বা বাউল কবি বইলা থাকেন। কিন্তু আসলে তিনি বাউল কবি নাহ। যারা মরমি কবিতা বা গান লিখেন তারা সবাই বাউল নাহ। যখন তার জীবন ও তার গাওয়া গানগুলার দিকে ভালো কইরা তাকানো হয় তখন এইটা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে উনি বাউল ছিলেন নাহ। বাউল শব্দটার উৎপত্তি নিয়া বিভিন্ন মতবাদ আছে। কুনু কুনু গবেষকের কথানুযায়ী বৌদ্ধদের বজ্রযান নামক সম্প্রদায় থাইকা বাউল শব্দটা আসছে। তারা নির্বান লাভের জন্য নিজের দেহের মধ্যকার ইন্দ্রিয়গুলার বিকাশ এবং এর মাধ্যমে তাদের জন্মান্তরের শিকল থাইকা মুক্তি লাভ করার জন্য সাধনা করতেন। আবার অনেকের মতে সংস্কৃত বাতুল শব্দের অপভ্রংশ রূপে বাউল শব্দের উৎপত্তি হইছে। সেইখানেও আমরা দেখতে পাই যে বাউলরা কুনু ধর্ম মানেন নাহ। এই সকল বাউলেরা মুসলিমদের শরীয়ত ও হিন্দুদের সংহিতা এইগুলা না মাইনা তাদের নিজেদের মতে সাধনা করতেন। এমনকি এমনও আছে হিন্দুর গুরু ছিলেন মুসলিম এবং মুসলিমের গুরু হিন্দু। তো এইসব মতবাদ বিশ্লেষন করলে এইটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে রাধারমণ কুনুভাবেই বাউল নন। কারণ তিনি কখনোই তার ধর্ম পরিত্যাগ করেন নাই। উল্টা তিনি হিন্দু ধর্মের মধ্যকার যে চতুরাশ্রম, ব্রহ্মচর্যাশ্রম, গার্হস্থাশ্রম, বাণপ্রস্থাশ্রম ও সন্ন্যাস পর্যায়ক্রমে পালন কইরা গেছেন।

রাধারমণ মূলত ছিলেন বৈষ্ণব-সহজিয়া দর্শনের অনুসারী। সহজিয়া মূলত একটা বিশেষ ধর্মমত, যা সহজপথে সাধনা করাকে বুঝায়। বৈষ্ণব-সহজিয়াদের মূল আদর্শ রূপ-প্রেম-আনন্দ। এই ধর্মমতে পরকীয়া প্রেমে বিশ্বাস করা হয়। তাদের কাছে এইটার মধ্য দিয়া সিদ্ধিলাভ সম্ভব এমনটা মনে করা হয়। রাধারমণের অনেক গানেই এই বিষয়টা লক্ষ্য করা যায়। তার গানগুলায় রাধাকৃষ্ণ-এর প্রেমলীলাটারে খুব গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হইছে। এছাড়া অন্যান্য গানেও দেখা যায় যে কুনু নারীর জায়গা থাইকা হয়তো গানটা গাওয়া হইতেছে তো তখন সেইখানে এইরকম লাইন আছে যে ঘরে শ্বাশুড়ি-ননদী আছে তো সে কিভাবে বাইরে যাইবো বা এই টাইপ কিছু।এইখানে পরকিয়া জিনিশটার আভাস পাওয়া যায়।

তার অনেক গানের শেষদিকের একটা লাইন খুব কমন সেইটা হইলো “ভাইবে রাধারমণ বলে” মানে “ভেবে রাধারমণ বলে” তো এইটা তার গানের একটা স্পেশাল সিগনেচার বলা যায়। তার অনেক গানের মধ্যেই একই জিনিশ লক্ষ্য করা যায়। মানে একই কথা, একই মিনিং। তো আমি তার এইরকম গানগুলা থাইকা আমার পছন্দের গান বাছাই করার ক্ষেত্রে যেই কাজটা করছি সেইটা হইলো যেই গানগুলা একই রকম কথা বা মিনিং বুঝাইতেছে সেইগুলার মধ্য থাইকা মাত্র দুই একটা রাখার ট্রাই করছি। পছন্দ হইলেও এর বেশি রাখি নাই। কারণ অনেক সময় হয় কি একই মিনিং এর গান হইলেও দেখা যায় যে হয়তো একটা লাইনের জন্যই এইটা ভালো লাইগা গেছে। কিন্তু যেহেতু একই মিনিং তো যদি একই রকম অনেকগুলা রাখা হয় আমার কাছে মনে হয় এইটা সৌন্দর্যটা নষ্ট কইরা ফেলে আসলে।

তার কিছু গানের মধ্যে দুনিয়ার মিছা মায়াজালে বন্দি হইয়া জীবন যে চইলা যাইতেছে,নিজের করা পাপের জন্য যে অনুতাপ, দুনিয়াতে আসলে যে আপন কেউ নাই এই টাইপের কিছু জিনিশ খুবই গভীর ও সুন্দরভাবে ফুইটা উঠছে। প্রেম জিনিশটারে তিনি বিভিন্নভাবে তার গানে তুইলা আনছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরহের মধ্য দিয়া। আবার অনেক সময় দেখা গেছে উনি প্রেমিকের অপেক্ষারত হইয়া কুঞ্জ সাজানোর কথা বলতেছেন। অনেক সময় আকুতি করতেছেন বন্ধু বিনোদিয়া যেন দয়া কইরা আসে বা শ্যাম বন্ধুরে বলতেছেন সে যদি দয়া কইরা না আসে তাহলে তার মতো ঘোর পাপীরে কে নিবো তরাইয়া (উদ্ধার কইরা)। গুরুর চরণ পাইবার আশায় বইসা থাইকা অনেক সময় তার দিন যাইতেছে গইয়া (পাড় হয়ে)। অনেক সময় গৌর বিচ্ছেদের জ্বালা নিয়া গান গাওয়া হইছে। বিচ্ছেদের যন্ত্রণারে কত সুন্দর কইরা ফুটাইয়া তুলছেন তিনি তার গানগুলায়। এইসব জিনিশই আমি খেয়াল করছি আমার পছন্দের গান বাছাই করার সময়।

সুরাইয়া দীনা

 

আমি কারে বা দেখাব মনের দুঃখ গো

আমি কারে বা দেখাব মনের দুঃখ গো হৃদয় চিরিয়া।
আমার সোনার অঙ্গ মলিন হইল ভাবিয়া চিন্তিয়া॥

পুরুষজাতি সুখের সাথী নিদয়া নিৰ্মায়া।
তারা জানেনা মনের বেদন কঠিন তাদের হিয়া॥

আমি সাদে সাদে প্রেম করিলাম সরল জানিয়া।
আমারে ছাড়িয়া গেল প্রাণনাথে কী দোষ পাইয়া॥

ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া।
আমার জগতে কলঙ্ক রইল পিরিতি করিয়া॥

 

আমার নারীকুলে জন্ম কেন দিলায় রে

আমার নারীকুলে জন্ম কেন দিলায় রে দারুণ বিধি
নারীকুলে জন্ম দিয়া ঘটাইলায় দুর্গতি রে॥

শিশুকালে পিতার অধীন, যৌবনেতে স্বামীর অধীনরে
ওরে বৃদ্ধকালে পুত্রের অধীন আমারে বানাইলায় রে ॥

যদি আমি পুরুষ হইতাম মোহন বাঁশি বাজাইতাম রে
কত নারীর মন ভুলাইতাম বাজাইয়া মুরলী রে॥

ভাইবে রাধারমণ বলে নারী জনম যায় বিফলে রে
না লাগিল সাধের জনম বন্ধুয়ার সেবায় রে।।

 

ভোমর কইও গিয়া

ভোমর কইও গিয়া,
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া।

ও ভোমররে কইও কইও কইও আরে কৃষ্ণরে বুঝাইয়া।।

ওরে ভোমর রে না খায় অন্ন না খায় জল নাহি বান্দে কেশ
ঘর থাকি বাইর হইলা যেমন পাগলিনীর বেশ।।

ও ভোমর রে উজান বাঁকে থাকো রে ভোমর
ভাইটাল গাঙে থানা
চোখের দেখা মুখের হাসি কে কইরাছে মানা।।

ও ভোমর রে, ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
নিভা ছিলো মনেরই অনল কে দিল জ্বালাইয়া।।

 

ইতা কিতা করে গো 

ইতা কিতা করে গো বন্দে পায়ে কেনে ধরে
শুনছনি সই পুরুষ হইয়া নারীর পায়ে ধরে

যার কুঞ্জে গেছলায় বন্ধু তার কুঞ্জেতে যাও
আমার বিছানায় তুমি না তুলিও পাও ৷

হায় বন্ধু হায় বন্ধু বলে বালিশ লইলাম কোলে
দারুণ শিমুলের তোলা বুলাইলে না বুলে ॥

ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
নিজগুণে প্রাণবন্ধু দিলায় আইয়া ধরা ॥



আমার বন্ধু দয়াময়

আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়
আরে তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয়।।

কদম ডালে বইসারে বন্ধু রঙ্গে ঢঙ্গে আগা
শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা ॥

তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙ্গের বাঁশি
সুর শুনিয়া রাধার মন হইল উদাসী

ভাইবে রাধারমণ বলে মনের কথা কয়
কৃষ্ণ প্রেমে রাধার মন প্রেমানলে দয়॥

 

আমারে করগো উদ্ধার

আমারে কর গো উদ্ধার, আমি অধম দুরাচার।
কত পাপের ভরা লইছি মাথে, হইয়াছি দ্বিগুণ ভার ॥

সোনা থইয়ে, দস্তা লইয়ে, করিতেছি রঙ্গের কারবার।
কত হীরামন মানিক্য থয়া, রাংচায় মন মজিল আমার ৷

ভাইবে রাধারমণ বলে, আমি ভুলিয়ে রইলাম মায়াজালে।
আমার মতো পাপী বুঝি ত্ৰিজগতে নাই গো আর।

 

আমি রবনা রবনা গৃহে

আমি রবনা রবনা গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না
বন্ধু আমার চিকন কালা নয়নে লাইগাছে ভালা
বিষম কালা ধইলে ছাড়ে না।

বন্ধু বিনে নাইযে গতি কিবা দিবা কিবা রাতি
জ্বলছে আগুন আর তো নিভে না।

এমন সুন্দর পাখি হৃদয়ে হৃদয়ে রাখি
ছুটলে পাখি ধরা দেবে না।

হাতে আছে স্বরমধু গৃহে আছে কূলবধূ
কী মধু খাওয়াইল জানি না।

ভাইবে রাধারমণ বলে প্রেমানলে অঙ্গ জ্বলে
জ্বলছে আগুন আর তো নিভে না॥

 

জলে গিয়াছিলাম সই

জলে গিয়াছিলাম সই, জলে গিয়াছিলাম সই
এগো কালা কাজলের পাখি দেইখা আইলাম অই॥

আর সোনারও পিঞ্জিরা ময়না রূপার টাঙ্গুনি
এগো আবেরা চান্দুয়া দিয়া পিঞ্জিরা ঢাকুনি।৷

আর পালিতে পালছিলাম পাখি দুধ কলা দিয়া
এগো যাইবার কালে নিষ্ঠুর পাখি না-চাইলো ফিরিয়া॥

আর ভাইবে রাধারমণ বলে পাখি গেল কই
এগো আইনা দে মোর প্রাণপাখি পিঞ্জিরাতে থই॥

 

বলে না ছিলাম গো পিয়ারি

বলে না ছিলাম গো পিয়ারি অ তুই পিরিত করিছ না
পিরিতি বিষম জ্বালা প্রাণে তো বাঁচবি না ॥

বনে থাকে ধেনু রাখে শ্যামকালিয়া সোনা
অবলা রমণীর মরম রাখালে জানে না ॥

কতই না বুঝাইয়াছিলাম শুনেও শুনলে না
নয়নের জল হইল সম্বল সার হইল ভাবনা ॥

রাধারমণ বলে প্রেম করিলে পাইতে হয় লাঞ্ছনা
তাই ভাবিয়া প্রেম না করিয়া আছে বা কয়জনা॥

 

শ্যাম কালিয়া সোনা বন্ধুরে

শ্যাম কালিয়া সোনা বন্ধুরে নিরলে তোমারে পাইলাম না
আমার মনে যত দুঃখ আমি খুলিয়া কইলাম না, বন্ধুরে।।

ফুলের আসন, ফুলের বসন রে বন্ধু ফুলেরই বিছানা
ওরে হৃদকুসুমে চুয়া চন্দন ছিটাইয়া দিলাম না বন্ধু রে।।

ক্ষীর ক্ষিরীয়া মাখন ছানারে বন্ধু রসেরই কমলা
দুই হস্তে চান্দ মুখে আমি তুইলা দিলাম না বন্ধুরে।।

ভাইবে রাধারমণ বলে রে বন্ধু মনেরই বাসনা
ওরে চিরদিন কি যাবে আমার কান্দিয়া কান্দিয়া বন্ধুরে।।

 

প্রাণসখীরে ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে

প্রাণসখীরে ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে?
বংশী বাজায় কেরে ধনি বংশী বাজায় কে।
মাথার বেণী বদল দেব তারে আনিয়া দে॥

বংশী নয়গো কালভুজঙ্গ বংশী লরাধারী
এমন নির্লজ্জ বাঁশি ডাকে নাম ধরি।

অষ্ট আঙুলা বাঁশি তরল বাঁশের আগা
কেমনে জানিলায় বাঁশি আমার নাম রাধা॥

রাধা রাধা বলে বাঁশি, বাঁশি আমার কুলবিনাশী
দারুণ বাঁশির সুরে মাইলো জাতিকুল॥

ভাইবে রাধারমণ বলে শুনগো সখী সকলে
বাঁশের বংশ করমু বিনাশ যে কোন কৌশলে॥

 

গলায় হার খুলিয়া নেও গো ও ললিতে

গলায় হার খুলিয়া নেও গো ও ললিতে।
এগো হার পরিয়া কি ফল আছে বন্ধু নাই মোর কুঞ্জেতে॥

ললিতায় নেও গলায় মালা বিশাখায় নেও হাতের বালা
এগো খুলিয়া নেও কানের পাশা আর আশা নাই মোর বাঁচিতে॥

হারের কীবা শোভা আছে যার শোভা তার সঙ্গে গেছে
এখন কৃষ্ণনামের হার গড়িয়া পৈরাও আমার গলেতে॥

ভাইবে রাধারমণ বলে প্রেমানলে অঙ্গ জ্বলে
এগো কৃষ্ণনামের পৃতদেহ ভাসাও নিয়া জলেতে॥

 

বন্ধু আইলায় না

বন্ধু আইলায় না আইলায় না আইলায় না রে
দারুণ কোকিলার রবে ভাসিয়া যায় রে।
এক প্রহর রাত্র বন্ধু আউলাইল মাথার কেশ
বন্ধু আসিলে বলি ধরি নানান বেশ৷

দুই প্রহর রাত্র বন্ধু বাটা সাজাইল পান
বন্ধু আসিবে বলে পাইলাম অপমান।
তিন প্রহর রাত্র বন্ধু গাছে ফুটল ফুল
নিশ্চয় জানিও বন্ধু গন্ধে ব্যাকুল॥

চাইর প্রহর রাত্র বন্ধু সাজাই ফুলের সজ্জা।
পঞ্চপ্রহর রাত্র বন্ধু শীতল বাতাস বয়
নিশ্চয় জানিও বন্ধু তুমি আমার নয়।

ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া।
অভাগিনী চাইয়া রইছি পন্থ নিরখিয়া॥

 

সারা নিশি কই ছিলায়

সারা নিশি কই ছিলায় রে রসরাজ
গোপীর মন চোরা॥

যার কুঞ্জেতে ছিলায় বন্ধু তার কুঞ্জেতে যাও
আমার বিছানায় তুমি না তুলিও পাও॥

তোমার পিরিতে বন্ধু জানাই নমস্কার
চন্দ্রাবলীর বন্ধু তুমি দণ্ডবৎ আমার॥

যার কুঞ্জেত ছিলায় বন্ধু তারে আমি চিনি
গোকুল নগরের মাঝে রাধা কলঙ্কিনী॥

রমণ বলে ওগো ধনী মান করিস না তোরা
নিজগুণে প্রাণবন্ধে এসে দিল ধরা॥

 

আমারে আসিবার কথা কইয়া

আমারে আসিবার কথা কইয়া
মান করে রাই কেন রইলায় শুইয়া॥

ও রাধেগো ডাকিতে না কর রাও, কেন মায়া নিদ্রা যাও
আশা দিয়া আনিলায় আমারে
আমি আশার আশে রহিলাম বসে গো রাধে, বাহিরে দাঁড়াইয়া॥

আমার মনে দিয়া দুঃখ, পাইতেছ কত সুখ
জীবনভরা মরিবায় ঝুরিয়া।
আমায় বড় কষ্ট দিলায় গো রাধে তোমার দ্বারেতে আনিয়া॥

ভাইবে রাধারমণ বলে; কেন শ্যামকে কাঁদাইলে
শ্যাম যদি যায়গো চলে, ঐ যে মথুরায়
আমার মান ভাঙিব, মিলন গাইব গো রাধে, শ্যামচানকে লইয়া॥

 

ছাড়িয়া না দিব বন্ধুরে

ছাড়িয়া না দিব বন্ধুরে ছাড়িয়া না দিব
তুমি যদি ছাড় বন্ধুরে আমি না ছাড়িব।
ওরে সুনারো পুতুলের মতো হৃদয়ে রাখিব ॥

তুমি হইবায় কল্পতরুরে বন্ধু আমি হইব লতা
ওরে দুই চরণে বান্ধিয়া রাখিমু ছাড়িয়া যাইবায় কোথা ॥

ভাইবে রাধারমণ বলে রে বন্ধু মনেতে ভাবিয়া
অভাগীর সঙ্গে নেও নিজ দাসী জানিয়া॥

 

কুঞ্জ সাজাও গিয়া

কুঞ্জ সাজাও গিয়া, আসবে শ্যাম কালিয়া
মনোরঙ্গে সাজাও কুঞ্জ সব সখী মিলিয়া।

জবাকুসুম সন্ধ্যামালী আনরে তুলিয়া
মনোসুখে গাঁথো মালা কৃষ্ণ নাম লইয়া॥

সব সখী সাজাই কুঞ্জ থাকরে বসিয়া
সুখের নিশি গত হয় আসে না বিনোদিয়া॥

ভাইবে রাধারমণ বলে সখী না কান্দ বসিয়া
নিশিভোরে আসবে শ্যাম বাঁশরি বাজাইয়া॥

 

সুখের নিশিরে বিলয় করি প্রভাত হইও না

সুখের নিশিরে বিলয় করি প্রভাত হইও না
তুমি নারী হইয়ে নারীর কোনো বেদন জানো না ৷

ও নিশিরে আমার একটা কথা রাখ আঁধার হইয়া থাক
প্রভাতকালে যাবে ফেইলে কেন নিশিরে।
তুমি যদি হওরে প্রভাত আমার বুকে দিয়ে আঘাত
তুমি নারী বধের পাতকিনী হবে রে।

ও নিশির রাত্র প্রভাতকালে কোকিলায় পঞ্চম বুলে
বিনয় কইরমু কোকিলার চরণে নিশিরে।

ভাইবে রাধারমণ বলে রাই ধইরাছে শ্যামের গলে
আমি কেমনে তোরে করিতাম বিদায় রে ॥

 

সজনী, আমি ভাবের মরা মইলাম না

সজনী, আমি ভাবের মরা মইলাম না,
স’জ পিরিতি হইল না।

সহজ পিরিতি হইতে পারে—
দুইজন হইলে একমনা॥

মধুর লোভে কাল ভ্রমরে
করছে আনা-যানা
শুকাইলে কমলার মধু
ফিরে ভমর আসবে না॥

আর ভাইবে রাধারমণ বলে—
মনের ওই বাসনা।
সহজ পিরিতি সিংহের দুধ
মাটির বাসনে টিকে না॥

 

ইলিশামাছ কি বিলে থাকে

ইলিশামাছ কি বিলে থাকে
কাঠাল কি কিলাইলে পাকে
মধু কি হয় বলার চাকে
মধু থাকে মধুর চাকে।

বিন্দু করি জমায় পোকে
মধু কি হয় বলার চাকে
আছে একাল চাকে।

ভাইবে রাধারমণ বলে বিপিনরে
তুই কি কাজ কইলে
ধান তুই বাইন করলে শাইল
ক্ষেতে আমন দিলে
আর কি বীচের নাগাল পাবে ৷

 

শ্যাম বন্ধুয়া দেখা দেও

শ্যাম বন্ধুয়া দেখা দেও অধম জানিয়া
আমি খাপ ধরি বসিয়া রইছি পন্থপানে চাইয়া।

সাধন ভজন জানিনা আমি আছি বোকা হইয়া
তুমি আসিয়া করবায় দয়া এই ভরসা লইয়া।

আইজ আইবায় কাইল আইবায় মনেতে করিয়া
দৃঢ়ভাবে আছি আমি ভরসা করিয়া।

তুমি যদি নাই আসো অপার দয়া করিয়া
আমার মত ঘোর পাপীরে কে নিবে তরাইয়া।

ভাবিয়া রাধারমণ বলে বন্ধু বিনোদিয়া
দয়া করিয়া আইসো বন্ধু অধম জানিয়া।

The following two tabs change content below.
সুরাইয়া দীনা

সুরাইয়া দীনা

মিশিগানের বাংলাটাউন খ্যাত ছোট শহর হ্যামট্রামিকে বাস।বেড়ে ওঠা সুনামগঞ্জে।
সুরাইয়া দীনা

Latest posts by সুরাইয়া দীনা (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →