(বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৩
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ১
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ২
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৩
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৪
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫
৬: সমসাময়িক পৃথিবী
হযরত মুহম্মদের আবির্ভাবকালে জগতের ধর্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি কিরূপ ছিল?
এক কথায় উত্তর দিতে গেলে বলিতে হয়: সে সময়ে জগতে সত্যই আঁধার যগে নামিয়া আসিয়াছিল। আরব, পারশ্য, মিশর, রোম, ভারতবর্ষ প্রভৃতি তৎকালীন সভ্য জগতের সর্বত্রই সত্যের আলো নিভিয়া গিয়াছিল। জবুর, তাওরাৎ, বাইবেল, বেদ প্রভৃতি যাবতীয় ধর্মগ্রন্থই বিকৃত ও রূপান্তরিত হইয়া পড়িয়াছিল, ফলে স্রষ্টাকে ভুলিয়া মানুষে সৃষ্টির পায়েই বারে করে মাথা নত করিতেছিল। তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ জগৎ হইতে লুপ্তপ্রায় হইয়াছিল; প্রকৃতি-পূজা, প্রতিমা-পূজা, প্রতীক-পূজা, পুরোহিত-পূজা অথবা ভূত-প্রেত ও জড়পূজাই ছিল তখনকার দিনে মানুষের প্রধান ধর্ম। রাষ্ট্রিক, সামাজিক বা নৈতিক শৃঙ্খলা কোথাও ছিল না। অনাচার, অবিচার, অত্যাচর ও ব্যভিচারে ধরণী পীড়িত হইয়া উঠিয়াছিল।
আমরা একে একে ঐ সমস্ত দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে এইখানে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব।
ভারতবর্ষ
ভারতবর্ষের অবস্থা তখন অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। বেদের কোন কোন সূত্রে ‘অজ’, ‘অকায়ম’ ও ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ ঈশ্বরের উল্লেখ থাকিলেও আর্যগণ দেবদেবীর আরাধনাই করিতেন। জনৈক খ্যাতনামা লেখক বৈদিক যুগের ধর্ম ও সংস্কার সম্বন্ধে বলিতেছেন: “বৈদিককালের ধর্ম ছিল ভৌতিক প্রকৃতির প্রত্যক্ষগোচর পদার্থের বা দৃশ্যের আরাধনা। বেদের ধর্ম বহুদেববাদ বলা যাইতে পারে।”
“প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ব্যাপার যেমন দেবত্ব লাভ করিয়াছিল, পার্থিব বহু বস্তুও তেমন দেবত্ব লাভ করিয়াছিল। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্র-বিদ্যুৎ, ঊষা, রাত্রি প্রভৃতির সংগে সংগে জল, নদী, পর্বত, ওষধি, গাভী, অস্পৃশ্য প্রভৃতিও দেবতাত্মা বলিয়া বন্দিত হইত।”*
[শ্রীযযুক্ত চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বেদবাণী ১৪ ও ২২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]
বৈদিক যুগের কিছুকাল পরেই আর্যদিগের মধ্যে বর্ণাশ্রম প্রথার প্রচলন হইয়াছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র — এই চারি বর্ণে গোটা হিন্দুসমাজ বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। একমাত্র ব্রাহ্মণদেরই বেদপাঠের এবং পৌরোহিত্য করিবার অধিকার থাকায় ব্রাহ্মণেতর লোকদিগের কোন ধর্মাধিকারই ছিল না। বহু সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অধিকার হইতে তাহারা বঞ্চিত ছিল। হিন্দু শাস্ত্রকার মনু বলিতেছেন:
“যে ব্রাহ্মণ শূদ্রকে ধর্মোপদেশ প্রদান করিবেন, তিনি সেই শাস্ত্রের সহিত অসংবৃত্ত নামক নরকে নিমগ্ন হইবেন!” মনুসংহিতা, ৪।৮১
নারীজাতির অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। বেদমন্ত্রে তাঁহাদের কোন অধিকার ছিল না! নারীকে পুরুষের দাসীরূপেই গণ্য করা হইত, কোনরূপ সামাজিক অধিকার বা মর্যাদা তাঁহার ছিল না। নারীর চরিত্র বা প্রকৃতি সম্বন্ধেও তখনকার যুগে অত্যন্ত হীন ধারণাই লোকে পোষণ করিত। স্বয়ং মনু বলিতেছেন:
“মন্ত্র দ্বারা স্ত্রীলোকদিগের সংস্কারাদির ব্যবস্থা হয় না, একারণ উহাদের অন্তঃকরণ নির্মল হইতে পারে না।”
এইরূপে সমাজের প্রতি স্তরে বহু পাপ ও বহু জঞ্জাল পঞ্জীভূত হইয়াছিল।
চীন
চীনাদের অবস্থা ভারতীয়দিগের অপেক্ষাও শোচনীয় ছিল। অতি প্রাচীনকাল হইতেই চীনাদিগের মধ্যে প্রকৃতি-পূজা, পুরোহিত-পূজা ও পূর্বপুরুষ-পূজার পদ্ধতি চলিয়া আসিতেছিল। নর-পূজাই ছিল তাহাদের প্রধান ধর্ম। অতঃপর বৌদ্ধধর্ম যখন চীনদেশে প্রবেশলাভ করে, তখনও অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। বরং বুদ্ধের নিরীশ্বরবাদ চীনাদের জীবনে আরও ঘোরতর অধঃপতন আনয়ন করিয়াছিল। চীনারা নৈরাশ্যবাদী নাস্তিক হইয়া পড়িয়াছিল। বুদ্ধের মূর্তিপূজা এবং নৃপতি পূজাই তাহাদের সার ধর্মে পরিণত হইয়াছিল। কোনরূপে নীতিজ্ঞান ছিল না; কর্মই ছিল তাহাদের একমাত্র চিন্তার বিষয়।
পারশ্য
অতি প্রাচীনকাল হইতেই পারশ্যে অগ্নি-উপাসনা ও প্রকৃতি-পূজার প্রচলন ছিল। প্রাচীন পারশিকদের ধর্মগুরু, ছিলেন জরদস্ত্ বা Zoroaster এবং তাহাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল জিন্দাবিস্ত। কালক্রমে এই ধর্মও লোপ পাইল। তখন পৌত্তলিকতা তাহার সমস্ত অভিশাপ লইয়া পারশিকদিগের মধ্যে আসন পাতিল। পুরোহিতদিগের অত্যাচারে পারশ্যবাসীরা জর্জরিত হইয়া উঠিল। ষষ্ঠ শতাব্দীতে তাহাদের সমাজ-বন্ধন একেবারে শিথিল হইয়া পড়িল। দুর্নীতি ও কুসংস্কারের অন্ধকারে পারশ্য ডুবিয়া গেল।
ইহুদী জাতি
ইহুদী জাতির দশা চিন্তা করিলে সত্যই দুঃখ হয়। এই জাতি পূর্বে আল্লাহ তালার ‘অনুগৃহীত’ জাতিরূপে পরিগণিত ছিল। ইহাদেরই উদ্ধারের জন্য আল্লাহতালা হযরত মুসা, হযরত দাউদ, হযরত সোলায়মান প্রভৃতি পয়গম্বরদিগকে প্রেরণ করেন এবং ‘জবুর’ ও ‘তাওরাত’ নামক দুইখানি ধর্মগ্রন্থ ইহাদের মধ্যে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু এত বড় স্বর্গীয় সম্পদ লাভ করা সত্ত্বেও আপন কর্মদোষে ইহারা আজ অবুলপ্ত ও নিগৃহীত। বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুরতা ছিল তাহাদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। হযরত মুসা, হযরত ঈসা, হযরত মুহম্মদ প্রভৃতি পয়গম্বরদিগের সহিত ইহারা বিশ্বাসঘাতকতা করিতে ছাড়ে নাই। হযরত মুসাকে ইহারা ভীষণভাবে নিযার্তন করিয়াছে; যিশুখৃষ্টকে ক্রুশে বিদ্ধ করিয়াছে এবং হযরত মুহম্মদকেও মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছে। এক ইহুদী রমণী হযরত মুহম্মদকে নিমন্ত্রণ করিয়া বিষদান করিয়াছিল। আল্লাহ তালার অনুগ্রহে হযরত রক্ষা পাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু সেই বিষের ক্রিয়া তিনি সারাজীবন ধরিয়াই অনুভব করিয়াছিলেন।
বড় বড় পয়গম্বরগণ যাহাদের হাত হইতে রক্ষা পান নাই, সে জাতির আভ্যন্তরীণ অবস্থা কিরূপ শোচনীয় ছিল, তাহা আর বলিয়া বুঝাইবার প্রয়োজন রাখে না।
খৃষ্টান জাতি
ষষ্ঠ শতাব্দীতে খৃষ্টান জাতির অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। যিশুখৃষ্টের শিক্ষা ও বিধান পাদ্রী ও সাধুপুরুষদিগের হস্তে এতই বিকৃত হইয়া গিয়াছিল যে, স্বয়ং যিশু ফিরিয়া আসিলেও উহাকে আর নিজধর্ম বলিয়া চিনিতে পারিতেন না। যিশুখৃষ্টের মৃত্যুর পর সাধু পল, পিটার প্রভৃতি ধর্মযাজকেরা উহাকে ত্রিত্ববাদে (Trinity) পরিণত করিয়া ছাড়িয়াছিলেন! কালে কালে ‘Holy Roman Empire” নামে স্বতন্ত্র খৃষ্টজগৎ রচিত হইল এবং রোমের পোপ খৃস্টানদিগের যাবতীয় ধর্মসংক্রান্ত অপরাধের বিচার করিবার ক্ষমতা লাভ করিলেন। ধর্ম ও ঈশ্বরের নামে পোপেরা যে বীভৎস লীলাখেলা আরম্ভ করিয়াছিলেন, ইতিহাস-পাঠক তাহা জানেন। তাঁহারা ঘোষণা করিয়াছিলেন: স্বর্গের চাবি তাঁহাদের হাতে। যতবড় পাপই হউক, উপযুক্ত মূল্যে পোপের নিকট হইতে স্বর্গের ‘পাসপোর্ট’ ক্রয় করিলে আর তাহার কোন ভয় নাই, নির্ঘাৎ সে স্বর্গে যাইবে। বলা বাহুল্য, ইহার ফলে খৃষ্টান জগতে যে দুর্নীতি ও পাপের স্রোত বহিয়া গিয়াছিল, ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই।
আরব জাতি
আরবের অবস্থা সর্বাপেক্ষা শোচনীয় ছিল। চুরি-ডাকাতি, মারামারি অত্যাচার, অবিচার, ব্যভিচার, মদ্যপান, নারীহরণ প্রভৃতি যত রকমের পাপ ও দূর্নীতি থাকিতে পারে, আরব-চরিত্রে তাহার কোনটিরই অভাব ছিল না। আল্লাকে তাহারা একরূপ ভুলিয়াই গিয়াছিল। হযরত ইব্রাহিম আল্লাহ তালার ইবাদতের জন্য যে কাবা ঘর নির্মাণ করিয়াছিলেন, সেই ‘খোদার ঘরেই’ আরবেরা ৩৬০টি দেবমূর্তির প্রতিষ্ঠা করিয়া পূজা করিয়া আসিতেছিল।
নারীজাতির অবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। গৃহপালিত পশুর মতন তাহাদিগকে যদচ্ছা ব্যবহার করা হইত। পিতার মৃত্যুর পর তাহার পরিত্যক্ত স্ত্রী-কন্যাগণও পুত্রের ভোগে আসিত। কন্যাসন্তানকে অনেক সময় জীবিত প্রোথিত করা হইত। বিবাহিতা স্ত্রীদিগকে যখন খুশি তালাক দেওয়া যাইত। পক্ষান্তরে একই নারী একই সময় বিভিন্ন পুরুষকে বিবাহ করিয়া উৎকট সামাজিক বিশৃংখলার সৃষ্টি করিত।
আরবে দাস ব্যবসা প্রচলিত ছিল। হাটে-বাজারে দাসদাসীর ক্রয়বিক্রয় চলিত। সময়ে সময়ে কাবা গৃহে নরবলিও হইত। ইহাই ছিল আরব জাতির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য!
৭: শিশুনবী
হযরত মুহম্মদের জন্মের সপ্তাহ দুই পরেই মরুভূমি হইতে বেদুঈন-ধাত্রীরা শিশু সন্তানের অনুসন্ধানে মক্কানগরে আসিয়া উপনীত হইল। তখনকার দিনে আরবে ইহাই ছিল প্রচলিত প্রথা। সম্ভ্রান্ত আরব-পরিবারে কোন শিশুসন্তান জন্মিলে তাহার স্তন্যদান ও লালন-পালনের ভার ধাত্রীর হস্তে ন্যস্ত করা হইত। এজন্য ধাত্রীরা উপযুক্ত পুরস্কার ও বেতন পাইত।
প্রথমতঃ কেহই বিধবা আমিনার পুত্রকে গ্রহণ করিতে রাজী হয় নাই। অপেক্ষাকৃত ধনীগৃহের সন্তান-লাভের প্রতিই তাহাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল।
ধাত্রীদিগের সকলেই মনের মত এক-একটি শিশুসন্তান লাভ করিয়া ফিরিয়া গেল; কিন্তু ধাত্রী হালিমার ভাগ্যে মুহম্মদ ছাড়া অন্য কোন শিশু জুটিল না। তখন হালিমা স্বামীকে ডাকিয়া বলিলেন, “শূন্য হস্তে ফিরিয়া যাইয়া লাভ কী? এই এতিম শিশুটিকেই গ্রহণ করি, কি বল?” স্বামী উত্তর দিলেন: “নিশ্চয়ই। মুহম্মদকে গ্রহণ কর। হয়ত ইহার মধ্য দিয়াই আমাদের নসীব বুলন্দ হইবে।”
হালিমা তখন শিশু-মুহম্মদকে গ্রহণ করিলেন।
হালিমা ছিলেন বনি-সা’দ গোত্রের মেয়ে। এই সা’দ-বংশের লোকেরা সে-যুগে বিশুদ্ধ প্রাঞ্জল আরবী ভাষায় কথাবার্তা বলিবার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শহরের ভাষা নানা ধারার সংমিশ্রণে বিকৃত হইয়া পড়িয়াছিল, কাজেই বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষা এই গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আরবে কাব্যকলা ও ললিত ভাষার খুবই আদর ছিল। যাহার ভাষা যত উদ্দাম ও সাবলীল হইত, সর্বসাধারণ তাহাকেই শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের চক্ষে দেখিত। শিশু-মুহম্মদের লালন-পালনের ভার গিয়া পড়িল এই মার্জিতরুচি ও উন্নতমনা সা’দ-বংশের উপরে। পরবর্তীকালে হযরত মুহম্মদ যে কথা-বার্তায় মিষ্ট ও লালিত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করিতে পারিতেন, তাহার অন্যতম প্রধান কারণ এইখানে মিলিবে।
মুহম্মদকে নিজগৃহে লইয়া আসিবার সংগে সংগে হালিমা এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করিলেন। তাঁহার গৃহপালিত মেষগুলি অধিকতর পরিপুষ্ট হইয়া উঠিল এবং অধিক পরিমাণে দুগ্ধ দান করিতে লাগিল। খর্জুর বৃক্ষে প্রচুর পরিমাণে খর্জুর ফলিতে লাগিল; কোন দিক দিয়াই তিনি আর কোন অভাব অনুভব করিতে লাগিলেন না। আরও একটি আশ্চর্য ব্যাপার তিনি এই লক্ষ্য করিলেন যে, শিশুনবী যখন হালিমার স্তন্য পান করিতেন, মাত্র একটি স্তন্যই পান করিতেন, অন্যটি করিতেন না। মনে হইত মুহম্মদ যেন জানিয়া শুনিয়াই অপর স্তন্যটি তাঁহার দুধভাই…হালিমার আপন শিশুপুত্রের জন্য রাখিয়া দিতেন। এই সমস্ত ব্যাপার লক্ষ্য করিয়া হালিমা প্রথম হইতেই এই অনুপম শিশুটির প্রতি কেমন যেন আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন।
হালিমার এক পুত্র ও তিন কন্যা ছিল। পুত্রটির নাম আবদুল্লাহ এবং কন্যা তিনটির নাম আনিসা, হোজায়ফা এবং শায়েমা। শায়েমার বয়স তখন সাত-আট বৎসর। মুহম্মদের লালন-পালন কার্যে শায়েমা সর্বদা মাতাকে সাহায্য করিত। মুহম্মদকে সে বড়ই ভালবাসিত। আপন সহোদরের মতই সে তাহাকে স্নেহ করিত।
পরবর্তীকালে হযরত মুহম্মদের জীবনের সহিত কত সাহাবা, কত জ্ঞানীগুণীর কত সম্বন্ধই না স্থাপিত হইয়াছে, কিন্তু শায়েমা ও শিশুনবীর এই সম্বন্ধটুকু একেবারে অন্যবদ্য! এ যেন একটি ছোট্ট বেহেশতি ফুল, সকল দৃষ্টির অন্তরালে কালের এক নিভৃত কোণে চিরদিনের মত অক্ষয় ও ভাস্কর হইয়া আছে।
দুই বৎসর এইভাবে কাটিয়া গেল। হালিমা মুহম্মদকে আমিনার নিকট লইয়া আসিলেন। আমিনা পুত্রের স্বাস্থ্যোজ্জল মধর মূর্তি ও দিব্য কান্তি দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। মনে মনে তিনি আল্লাকে ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন। হালিমার উপরেও তিনি খুব সন্তুষ্ট হইলেন।
এই সময়ে মক্কায় অত্যন্ত সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হইল। এ-কারণ আমিনা মুহম্মদকে আরও কিছু দিন হালিমার তত্ত্বাবধানে রাখিয়া দেওয়া সংগত মনে করিলেন। বৃদ্ধ আব্দল মুতালিবও এ-প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। পুনরায় মুহম্মদ হালিমার গৃহে ফিরিয়া চলিলেন।
৮: খানিকটা গদ্য, খানিকটা কবিতা
দিগন্ত-বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে হালিমার কুটীর। বেদুঈন-জীবনের সমস্ত বৈশিষ্ট্য সেখানে বিদ্যমান। চতুর্দিকে মুক্ত স্বাধীন প্রকৃতি-মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস, মুক্ত প্রান্তর, তারি মাঝে মুক্ত মানুষের মুক্ত মন। কোথাও বাধা নাই, বন্ধন নাই, জীবনযাত্রার মধ্যে কোথাও কৃত্রিমতা নাই: প্রকৃতির সঙ্গে চমৎকার সুসংগতি তার। শুধু, জড়জীবনের ক্ষুধাতৃষ্ণা ও হাসিকান্নাই এজীবনের সবটুকু নয়। এর খানিকটা বাস্তব, খানিকটা স্বপ্ন, খানিকটা কঠোর, খানিকটা কোমল; খানিকটা গদ্য, খানিকটা কবিতা। প্রকৃতি হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন যে জীবন, তাহার কোন মাধুর্য নাই। প্রকৃতির সহিত মানুষ যেখানে মিলিয়া যায়, সেইখানেই জীবনের চমৎকারিত্ব।
এমনি পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে শিশুনবীর জীবনযাত্রা আরম্ভ হইল। শৈশবকাল শিক্ষার সময়। এই সময়ে শিশুর মনে যে-শিক্ষা ও যে-আদর্শের রেখাপাত করা যায়, তাহাই স্থায়ী হইয়া থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হযরত মুহম্মদের সেরূপ কোন শিক্ষার ব্যবস্থাই হইল না। কিন্তু সত্যই কি তাই? মুহম্মদের শিক্ষার কি কোন ব্যবস্থাই নাই?
পিতা নয়, মাতা নয়, শিক্ষক নয়, সমাজ নয়…স্বয়ং আল্লাহতালাই তাঁহার শিক্ষার ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। নবী-রসূলদের শিক্ষা তো এইভাবেই হইয়া থাকে। মানুষের শিক্ষা ও কৃত্রিম জ্ঞান তো তাঁহাদের জন্য নয়। তাঁহাদের শিক্ষার পদ্ধতি ও উপাদান সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। খোদা যেন কোন এক গূঢ় উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই মুহম্মদকে বারে বারে ঘর হইতে টানিয়া বাহিরে আনিলেন। সমাজের বিকৃত চিন্তা ও কলুষিত আদর্শের ছাপ পড়িবার পূর্বেই তিনি তাঁহাকে সরাইরা আনিয়া বিশাল মরুভূমির উদার পটভূমিতে স্থাপন করিলেন। তারপর প্রকৃতির বিরাট গ্রন্থ তাঁহার সম্মুখে খুলিয়া ধরিয়া একে একে তাঁহাকে প্রাথমিক পাঠ দিতে আরম্ভ করিলেন।
এই পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালে যে একজন নিয়ন্তা আছেন, তিনি যে আড়ালে থাকিয়া নানা বর্ণে, নানা গন্ধে, নানা গানে, নানা ছন্দে আপনাকে প্রকাশ করিতেছেন এ সত্য তিনি তাঁহার অন্তর দিয়া উপলব্ধি করিতে লাগিলেন। সকল জ্ঞানের, সকল সত্যের, সকল তথ্যের, উৎসমুখে যেখানে সেখানে বসিয়াই তিনি জ্ঞানামৃত পান করিতে লাগিলেন। মানুষের রচিত বিকৃত শিক্ষা কেন তিনি গ্রহণ করিবেন?
তাই তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন—উম্মি ছিলেন—ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিকই হইয়াছিল। অসম্পূর্ণ মানুষের অসম্পূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করিলেই তিনি ছোট হইয়া যাইবেন। মানষের দেওয়া জ্ঞান তাঁহার মনের উপর একটি পর্দার আড়াল টানিয়া দিত, চিরজ্যোতিময়ের জ্যোতিঃপুঞ্জ তখন আর প্রত্যক্ষভাবে তাঁহার চিত্তে আসিয়া প্রতিফলিত হইতে পারিত না। সৃষ্টি লীলার সমস্ত গোপন রহস্য ও মূল সত্যগুলি জানা হইলেই তো সব জানা হইয়া যায়। সেই জ্ঞানই তো পরম জ্ঞান। মুহম্মদ সেই স্বর্গীয় জ্ঞানেরই অধিকারী হইয়াছিলেন।
বস্তুতঃ হযরত মুহম্মদ সত্যই যে জগদগুরু ছিলেন, তাহার এক বড় প্রমাণ: তিনি নিরক্ষর ছিলেন—তাঁহার কোন গুরু ছিল না।
মুহম্মদের বয়স ধীরে ধীরে বর্ধিত হইতে লাগিল। তিনি এখন পাঁচ বৎসরের বালক।
কিন্তু এই অল্প বয়সেই মুহম্মদ অতিমাত্রায় চিন্তাশীল হইয়া উঠিলেন। কখনও তিনি উম্মনা, কখনও বা তিনি উদাস, কখনও বা তিনি ভাবগম্ভীর। দূরের পানে আঁখি মেলিয়া সর্বদাই তিনি কি-যেন-কি ভাবেন। দৃশ্য জগতের অন্তরালে ভাঙা-গড়ার যে লীলা চলিতেছে, তাহার রহস্য যেন তিনি পূর্বে জানিতেন, কিন্তু আজ আর মনে নাই। অর্থবিস্মৃত স্বপ্নের মত এই নিখিল মাখলুকাত কেবলি তাঁহাকে উতলা করিয়া তুলে। চেনা-অচেনার আলো-ছায়ায় মন তাঁহার সতত দুলিতে থাকে।
এমন যে হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী। মহাপুরুষদিগের জীবন প্রভাত এমনই বিচিত্র ও সুন্দর!
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- ঢাকা শহরের বইয়ের দোকান - ডিসেম্বর 4, 2023
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৩ - সেপ্টেম্বর 28, 2023
- ফিকশন: বিষাদ সিন্ধু [শর্ট ভার্সন]- মীর মোশারফ হোসেন (পার্ট ৯) - জুলাই 28, 2023